Mamata Banerjee

শোভনের উদ্দেশে ইঙ্গিত, রত্নাকে দায়িত্ব থেকে সরাল তৃণমূল

রত্নার অবশ্য দাবি, তাঁর থেকে দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়নি, তিনি নিজেই ছেড়ে দিয়েছেন।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২০ ১৭:০১
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের দেড় দিনের মধ্যে বদলে গেল ছবি। তৃণমূলে যাঁর উত্থান নিয়ে প্রবল অসন্তোষ প্রকাশ করছিল শোভন শিবির, সেই রত্না চট্টোপাধ্যায়ের কাঁধে আর কোনও দায়িত্ব রইল না। ‘বাংলার গর্ব মমতা’ কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্ব বেহালা পূর্ব এলাকায় দেওয়া হয়েছিল শোভন চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়কে। শনিবার সকালে জানা গেল, সেই দায়িত্ব আর পালন করতে হচ্ছে না রত্নাকে।

Advertisement

রত্নার দাবি, তাঁর থেকে দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়নি, তিনি নিজেই ছেড়ে দিয়েছেন। তবে অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে এ দিন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘বাংলার গর্ব মমতা— এই কথাটা প্রত্যেক তৃণমূল কর্মীর হৃদস্পন্দনে রয়েছে। সুতরাং এই কর্মসূচির ঝান্ডা কার হাতে ছিল বা এখন কার হাতে থাকবে, সেটা বড় কথা নয়। স্লোগানটাই বড় কথা।’’

শোভনের সঙ্গে যে সব বিষয় নিয়ে তৃণমূলের মনোমালিন্য চলছিল, তার মধ্যে অন্যতম দলে রত্নার উত্থান। শোভন চট্টোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দিলেও, তাঁকে তৃণমূলে ফেরানোর চেষ্টাও চলছিল সমান্তরাল ভাবে। কিন্তু সে পথে কাঁটা হয়ে উঠেছিলেন রত্না চট্টোপাধ্যায়। কারণ দলে তাঁর গুরুত্ব ক্রমশই বাড়ছিল, যা শোভনের আপত্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। এই প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক করেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তা কার্যত নিষ্ফলা হয়। তবে সেই পরিস্থিতি আচমকা গতি পায় গত বৃহস্পতিবার। ওই দিন নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় দেড় ঘণ্টার সেই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, তা নবান্ন থেকে বেরিয়ে স্পষ্ট করেননি বৈশাখী। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ব্যাখ্যা, সে দিনের বৈঠকের ফলই এ বার ফলতে শুরু করেছে। তাঁদের মতে, বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে দলীয় কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্ব থেকে রত্নার সরে যাওয়া আসলে পুরভোটের আগে শোভন চট্টোপাধ্যায়কে তৃণমূলের তরফে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া।

Advertisement

আরও পড়ুন: সোমবার থেকে বন্ধ রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চলবে উচ্চ মাধ্যমিক​

সামনে পুরভোট। তার পর ২০২১ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সেই লক্ষ্যেই রাজ্যের প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে ‘জলযোগে যোগাযোগ’ নাম দিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করছে জোড়াফুল শিবির। শুক্রবার সেই কর্মসূচি পালিত হয় বেহালা পশ্চিম অর্থাৎ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কেন্দ্রে। এ দিন সেই কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল বেহালা পূর্বেও। কিন্তু এ দিন সকালে জানা যায়, ওই সাংবাদিক বৈঠক হচ্ছে না। আরও জানা যায়, ওই কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য বেহালা পূর্বে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুশান্ত ঘোষকে। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার রাতে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজেই কলকাতা পুরসভার ১২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং ১৩ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সুশান্ত ঘোষকে এই দায়িত্ব বদলের কথা জানান। এর পর এ দিন সকালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতর থেকেও সুশান্তকে জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে রত্না বলছেন, ‘‘আমাকে বেহালা পূর্বের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি। আমি নিজেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি।’’

কিন্তু কেন দায়িত্ব ছাড়লেন? রত্না বলেন, ‘‘আমার পক্ষে বেহালা পূর্বে কাজ করা কঠিন হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এখানকার কাউন্সিলররা সবাই হয়তো আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইছেন না। তাই আমি আজ সকালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যয়ের অফিসে গিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে এসেছি।’’

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা কিন্তু মমতা-বৈশাখী বৈঠক এবং বেহালা পূর্বের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের অব্যাহতিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নন। বৃহস্পতিবার বিকেলে গোটা রাজনৈতিক শিবিরকে চমকে দিয়ে নবান্নে হাজির হয়েছিলেন বৈশাখী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেখানে তাঁর ঘণ্টা দেড়েকের বৈঠকের ফলই এ বার ফলতে শুরু করেছে বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই মত। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ দিনের মন্তব্য সেই জল্পনাকে আরও প্রশ্রয় দিচ্ছে। যে বৈশাখীর নানা মন্তব্যে এত দিন তৃণমূলের সঙ্গে বিস্তর দূরত্বই ধরা পড়ত, সেই তিনিই এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বেশ ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আনন্দবাজারকে তিনি বলছেন, ‘‘বাংলার গর্ব মমতা— এই কথাটা কাকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, সেটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই কথাটা আসলে বলানোর দরকারও পড়ে না। প্রত্যেক তৃণমূল কর্মীর হৃদস্পন্দনে এই কথাটা রয়েছে।’’


আরও পড়ুন: কাদের মাস্ক পরা দরকার আর কাদের তা আদৌ পরার প্রয়োজন নেই, জেনে নিন

বৈশাখী এ দিন আরও বলেন, ‘‘একটা কর্মসূচি যখন গৃহীত হয়েছে, তখন রূপায়ণ তো হবেই। আর রূপায়ণ হলে কেউ না কেউ দায়িত্বও পাবেন। কিন্তু বাংলার কোন ব্লকে কে কে এই কর্মসূচির দায়িত্ব পেলেন, সে সব কি কারও জানা আছে? নেই। শুধু বেহালা পূর্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষকের নাম নিয়েই কথা হচ্ছিল। কারণ একটাই। সেটা হল তাঁর পরিচয়টা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু শোভন চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় ভাঙিয়ে অন্য কেউ রাজনীতি করবেন, এটা যে শোভন চট্টোপাধ্যায় পছন্দ করছিলেন না, তা আশা করি সকলের কাছে স্পষ্ট।’’

শোভন নিজে যদিও এ নিয়ে কোনও মন্তব্য এখনও করেননি। কিন্তু বেহালা পূর্বের দায়িত্ব থেকে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের অপসারণ যে তাঁর সঙ্গে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের দূরত্ব এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিল, সে কথা শোভন ঘনিষ্ঠরা স্বীকার করছেন। ঘটনা প্রবাহ যে দিকে মোড় নিয়েছে, তাতে সব কিছু মসৃণ থাকলে আসন্ন পুর নির্বাচনের আগে নিজের পুরনো দলেই শোভনকে বড় ভূমিকা নিতে দেখা যেতে পারে, এমন ইঙ্গিতও শোভন ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ দিতে শুরু করেছেন।

রত্নার পরিবর্তে যিনি বেহালা পূর্বের দায়িত্ব পেলেন, সেই সুশান্ত ঘোষ (বুয়া) উচ্ছ্বসিত। আনন্দবাজারকে তিনি বলছেন, ‘‘দীর্ঘ দিন দলের হয়ে কাজ করছি। এত দিন পরে যে নেতৃত্ব আমাকে সেই কাজের স্বীকৃতি দিলেন, তাতে আমি খুব খুশি। বেহালা পূর্বে একের পর এক নির্বাচনে আমি দলীয় প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট থেকেছি। সুতরাং গোটা এলাকা আমার চেনা। কাজ করতে সুবিধাই হবে।’’

আরও পড়ুন: ছুটি নেই, উচ্চ মাধ্যমিকের সঙ্গেই শুটিং চলছে দিতিপ্রিয়ার

কিন্তু যে কারণে বেহালা পূর্বে কাজ করতে রত্নার অসুবিধা হল, সেই একই কারণে তাঁর সমস্যা হবে না তো? সুশান্ত বললেন, ‘‘না, আমার কোনও অসুবিধা হবে না। আমার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ভাল। আমি তো বললামই, পর পর দু’বার শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নির্বাচনী এজেন্টও ছিলাম। সুতরাং শোভন চট্টোপাধ্যায়ের আমাকে নিয়ে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’

সুশান্তর এই মন্তব্যেই স্পষ্ট যে, শোভনের আপত্তিই রত্নার অব্যাহতির নেপথ্যে প্রধান কারণ। শোভনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল বলেই যে বেহালা পূর্বে কাজ করতে গিয়ে তিনি রত্নার মতো সমস্যায় পড়বেন না, এই মন্তব্য বিশেষ ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। শোভনের মতামতকে যে আবার গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব, সুশান্তর মন্তব্য থেকে আরও স্পষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির। যাঁকে শোভন চট্টোপাধ্যায় পছন্দ করছেন না, শোভনের খাসতালুকের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দিয়ে শোভনের উদ্দেশে তৃণমূল যে অত্যন্ত ইতিবাচক বার্তা দিল, সে বিষয়েও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অধিকাংশই একমত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement