(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল ও কাজল শেখ। —ফাইল চিত্র।
গরু পাচার মামলায় গ্রেফতারির পর থেকে দলীয় সভা-সমাবেশের কাটআউট, ফেস্টুন থেকে বাদ গিয়েছিল তাঁর নাম-ছবি। জেলার রাজনীতিতে আলোচনা শুরু হয়েছিল তাঁর ‘ফিকে’ হয়ে যাওয়া নিয়েও। মঙ্গলবার দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তার পরেই আবার দলের ফেস্টুন, ব্যানারে ফিরল সেই অনুব্রত মণ্ডল (কেষ্ট)-এর নাম-ছবি!
অনুব্রতহীন বীরভূমে দলের সাংগঠনিক কাজকর্ম দেখছিল মমতারই তৈরি করে দেওয়া ন’জনের কোর কমিটি। মঙ্গলবার জেলার দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে সেই কমিটি আরও ছোট করে দেন দলনেত্রী। ধমক দেন জেলায় ‘অনুব্রত-বিরোধী’ বলে পরিচিত কাজল শেখকে। তাঁকে সরিয়ে দেন কোর কমিটি থেকে। কাজলের সঙ্গে কমিটি থেকে বাদ পড়েন জেলার দুই সাংসদ শতাব্দী রায় এবং অসিত মাল। বাদ পড়েন জেলা পরিষদের সদস্য বিশ্ববিজয় মার্ডিও। এর ফলে কোর কমিটিতে সদস্য সংখ্যা কমে পাঁচ জন হয়। এই পাঁচ জনের অধিকাংশই বীরভূমের রাজনীতিতে ‘অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত। পাশাপাশি তৃণমূলনেত্রীর মন্তব্য, অনুব্রত থাকলে বীরভূম নিয়ে তাঁকে ভাবতেই হত না! ঘটনাচক্রে, এর পর থেকেই অনুব্রতের নাম ও ছবি-সহ ফ্লেক্স লাগানো শুরু হয়েছে বীরভূমের জায়গায় জায়গায়। তাতে অনুব্রতের পাশে রয়েছে কোর কমিটির পাঁচ সদস্যের নাম-ছবিও। সিউড়ির কার্যালয়ে সেই রকমই একটি পোস্টার নজরে এসেছে। তাতে দলনেত্রী মমতাকে ধন্যবাদ ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়েছে। ফ্লেক্সে রয়েছে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিও।
অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তাঁর ছবি ও নাম ব্যবহারে প্রাথমিক ভাবে প্রভাব না-পড়লেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় কর্মসূচিতে তাঁর নামে স্লোগান বা তাঁর ছবি ব্যবহারেও ‘অলিখিত’ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। জেলার অনেক দলীয় কার্যলয়ের সামনে থেকেও সরানো হয়েছিল অনুব্রতের ছবি। জেলা তৃণমূল সভাপতির পদ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সরানো না-হলেও, কয়েক মাস আগে সব জেলার সভাপতির তালিকায় বীরভূমে অনুব্রতের নাম ছিল না। তার বদলে কোর কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাজলকে কোর কমিটিতে এনেছিলেন মমতাই। সেই কোর কমিটিই এত দিন অনুব্রতহীন বীরভূমে তৃণমূলের যাবতীয় কাজকর্ম সামলেছে। এর মধ্যে জেলা পরিষদে প্রথম বার দাঁড়িয়ে জেতেন কাজল। সভাধিপতিও হন। দলীয় সূত্রের দাবি, এর পর থেকে জেলায় কাজলের দাপট বাড়ছিল। দলের পোস্টার থেকে অনুব্রতের নাম-ছবি বাদ পড়ে তাতে ঠাঁই হচ্ছিল কাজলের।
নানুরের হোসেনপুর, বোলপুরের বাহিরি-পাঁচশোয়া এলাকায় দলীয় কার্যালয়ে তেমনই ছবি প্রকাশ্যে এসেছিল। সেখানে আগেই মোছা হয়েছিল অনুব্রতের নাম ও ছবি। পরে চুনকাম করা অংশের উপরে সাঁটানো হয় অভিষেক ও কাজলের ছবি। তখন থেকেই তৃণমূলের অন্দরে আলোচ্য হয়ে উঠেছে, তা হলে কি এ বার থেকে বীরভূমে কেষ্ট আরও ফিকে হবেন? থাকবেন কাজল? অনুব্রতকে ধীরে ধীরে দল ‘ঝেড়ে’ ফেলছে কি না, তা নিয়েও চর্চা বাড়ছিল জেলার রাজনীতি। দলের একাংশের মতে, মঙ্গলবার দলীয় বৈঠকে মমতার বার্তার পরেই আবার জেলায় গুরুত্ব বাড়ল অনুব্রত শিবিরের। তারই ফলস্বরূপ দলের ফেস্টুন ব্যানারে অনুব্রতের নাম-ছবি ফিরে আসা।
দলীয় সূত্রে খবর, বীরভূমের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে কাজলকে মমতা বলেছিলেন, “তুমি কত বড় নেতা হয়েছ যে, দল আর সরকার এক করে দিয়েছ! ৯ জনের কোর কমিটি তৈরি করে দিয়েছিলাম। এখন শুনছি, তুমি একা নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করছ।’’ এর পরেই কাজলকে কোর কমিটি থেকে সরানোর কথা বলেন দলনেত্রী। জেলা পরিষদের কাজে মন দিতে বলা হয় তাঁকে। দলীয় সূত্রের দাবি, জেলা পরিষদের সভাধিপতি হওয়ার পর থেকেই জেলায় কাজলের কিছু পদক্ষেপ ও মন্তব্যে দলের অন্দরে চাপা অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। জেলার রাজনীতিতে যাঁরা অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, তাঁদের কোণঠাসা করারও অভিযোগ তুলেছেন দলের কেউ কেউ। জেলায় তৃণমূলের একাংশের মতে, সে সব দলনেত্রীর কানে যাওয়ায় মঙ্গলবার তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মমতা রাখঢাক না রেখেই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কেষ্ট ফিরে এলে তাঁকেই আবার দায়িত্ব দেওয়া হবে। দলনেত্রী এমনও মন্তব্য করেন— ‘‘কেষ্ট থাকলে বীরভূম জেলা নিয়ে এত ভাবতে হত না! নেই বলে সবাই মিলে কাজ চালাতে হবে।’’
এই পরিস্থিতিতে কাজল অবশ্য বুধবার নিজেকে ‘অনুব্রতের শিষ্য’ বলেন কাজল। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো সব সময় বলি, আমি কেষ্টদার শিষ্য। তাঁর সৈনিক। আমার রাজনীতিতেও আসা কেষ্টদার হাত ধরেই।’’ পাশাপাশি নানুনের তৃণমূলের নেতার বক্তব্য, তাঁকে কোর কমিটি থেকে ‘বাদ’ দেওয়া হয়েছে বললে ভুল বলা হবে। আসলে কোর কমিটি ছোট করা হয়েছে। কাজলের কথায়, ‘‘বাদ দেওয়া হয়নি তো। কোর কমিটি ছোট করা হচ্ছে। কমিটিতে ন’জন ছিলেন। এখন পাঁচ জন করা হল। এত জন সদস্য থাকায় বৈঠক ডাকা যাচ্ছিল না। সাংসদেরা দিল্লিতে ব্যস্ত থাকছিলেন। আমি জেলা পরিষদের কাজে। এ সব ভেবেই হয়তো দলনেত্রী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’’