Puja

নীলকণ্ঠেই মুছে যাক অসুখ

এই ভাবে শশীমোহন ও তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে এখন রূপকথার গল্প বয়ে চলে। প্রতি আশ্বিনে তৈরি হওয়া নতুন নতুন রূপকথা।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২০ ০৪:৫১
Share:

ঢাকে বোল তুলেছেন শশীমোহন। নিজস্ব চিত্র

‘‘নামানি তাল বোঝেন?’’ মুখে হেঁয়ালির হাসি। ৬৪ বছর বয়সি প্রশ্নকর্তার গালের চামড়ায় ভাঁজ ধরতে শুরু করেছে, চুল পাতলা হয়েছে তবে পাক ধরেনি। তাঁকে ঘিরে বসে নানা বয়সের মানুষজন।একটু অপেক্ষা করে বলে উঠলেন, ‘‘দুর্গাঠাকুরের যখন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়, তখন ঢাকে যে তাল বাজে সেটাই নামানি তাল।’’ গলার স্বর একটু খাদে, ‘‘শুধু কি আর মন্ত্রে দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়? নামানি তাল না-বাজালে আপনাদের দুর্গাপুজোই হবে না।’’

Advertisement

আবার গলা ঝেড়ে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা, তবে ভোরাই তাল নিশ্চয়ই জানেন?’’ অপেক্ষা না-করে নিজেই দিলেন জবাব, ‘‘সপ্তমী থেকে দশমী, রোজ সকালে সূর্য ওঠার পরেই মণ্ডপে ঢাকের বাজনা শুনেছেন? সেই তালকেই বলে ভোরাই তাল। ওই বাজনা শুনেই মা দুর্গার ঘুম ভাঙে। আমাদের ঢাকের শব্দেই সকলে ঘুম থেকে ওঠে— দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ...’’সামান্য থামলেন ৬৪ বছরের শশীমোহন হাজরা। তাঁকে ঘিরে যাঁরা বসে, তাঁদের সকলেরই ঢাক বাজানোর হাতেখড়ি শশীমোহনের কাছে। তাঁদের দিক থেকে চোখ নামিয়ে শশীমোহন বলেন, ‘‘এ বছর নিশ্চয়ই সবাই ঘুমোচ্ছেন। না-হলে এত দুর্দশা হবে কেন?’’

এই শশীমোহনের বাবা গোকুল হাজরা নাকি নবমীর রাতে জ্বলন্ত ধুনুচি দাঁতে কামড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঢাক বাজাতেন। ঢাকির পা-ও নাচত, অথচ ধুনুচি থেকে একটা ফুলকিও ছিটকে পড়ত না। ধূপের গন্ধ মাখা মণ্ডপে তুফান তুলত গোকুলের বাজানো নবমী রাতের ছন্দ। ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ...। ধুনুচি থেকে ওঠা ধোঁয়া পাক খেয়ে স্পর্শ করত অসুরনাশিনী টানা টানা চোখের সালঙ্কারা মৃন্ময়ীকে।

Advertisement

আরও পড়ুন: ঝড় ঠেলেই সাফল্য নিটে, সব কৃতিত্ব মাকে দিচ্ছেন সৌরদীপ

আরও পড়ুন: তালিকা চান সূর্যেরা

শশীমোহন বলে চলেন, ‘‘ওই যে টগর গাছের ফাঁক দিয়ে পাকা বাড়ি দেখা যায়, ওটা বাসুদেবের। বিসর্জনের ঘাটে গিয়ে তিনি পায়ে ঘুঙুর বাঁধতেন। তখন তিনি পাগল-খেপা। রাত যত বাড়ে, ঢাকের জোরও বাড়ে। বাসুদেবের নাম প্রতি বার নাকি কমিটির মাইকে বলা হত। অনেক হাততালি পেত মানুষটা, গলায় টাকার মালা। গ্রামে ফিরে সেই মালা থেকে টাকা খুলে একটু একটু করে পাকা বাড়ি বানাল।’’

এই ভাবে শশীমোহন ও তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে এখন রূপকথার গল্প বয়ে চলে। প্রতি আশ্বিনে তৈরি হওয়া নতুন নতুন রূপকথা। সেই কাহিনিরা গ্রামের মাটির ভাঙা রাস্তায় হাঁটে, বুড়ো অশ্বত্থের নীচে তাসের আড্ডায় ঘোরে। ঘাসে আশ্বিনের হিম পড়লে নতুন নতুন সব কাহিনি মাথা তোলে গ্রামে।

গ্রামের নাম ঝিনাইবাড়ি। ঝিনাই একটি নদীর নাম। বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে আছে সেই নদী। এখন যাঁরা বয়স্ক, তাঁদের ঠাকুরদা-বাবা ঢাক নিয়ে একদিন নদী, ধানখেত পার হয়ে, কাশবনের পাশ দিয়ে পুব থেকে পশ্চিমে চলে এসেছিলেন। শশীমোহনকে ঘিরে থাকা ভিড়ে রয়েছেন গ্রামের ছোট, বড়, মুরুব্বি— সবাই। জলপাইগুড়ি শহর থেকে ভাঙা, সরু, মেঠো, নানা পথ পেরিয়ে ৩২ কিলোমিটার এই গ্রাম। ঢাকিপাড়ায় মূলত হাজরাদের বাস। তবে যে ক’জন রায়, বর্মণ, মণ্ডল আছেন, সকলে ঢাক বাজানো শিখে নিয়েছেন। অন্য বছরে এই সময়ে ঘরে ঘরে ঢাকের রেওয়াজ চলে।

সেই সব বছরের কথা বলতে বলতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল তাঁদের। সেই সব বছর শরতের সকালে কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সব। পাশে হয়তো বাড়ির দস্যি ছেলেটা বা বাপ-ন্যাওটা মেয়ে। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে হেঁটে যান বড় রাস্তার দিকে। বুড়ো অশ্বত্থ, ঘাট বাঁধানো পুকুর, গ্রামের নাম লেখা নীল-সাদা সাইনবোর্ড— সব পড়ে থাকে পিছনে। কেউ যান অসম, ত্রিপুরা, কেউ মেঘালয়ে। কেউ বা আবার নিজের রাজ্যেই, অন্য জেলায়।

কিন্তু তাঁরা সকলেই জানেন, এ যাওয়া তো নয় যাওয়া! দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি উড়বে। তার ডানায় উমার কৈলাসে ফেরার খবরের সঙ্গে থাকে তাঁদেরও ঘরে ফেরার বার্তা। এ বছর কী হবে? শশীমোহন নিরুত্তর। এখনও পুজো কমিটির ফোন আসেনি ওঁদের কাছে। ওঁরা নিজেরাই ফোন করেছিলেন চেনা কমিটিদের। কেউ যে টাকা বলেছে, তাতে রাহাখরচই উঠবে না। কেউ আবার বলেছেন, ‘‘এ বার থাক, ভাই। সামনের বার দেখব। বোঝেনই তো, লকডাউনটা সব শেষ করে দিয়েছে।’’

কিন্তু সেই দস্যি ছেলে বা বাপের জামা টেনে ধরা মেয়েটা কি বুঝবে? ঢাক বাজিয়ে মেডেল পেয়েছেন বিকাশ হাজরা। বলছিলেন, ‘‘পুজো তো পরের কথা, ছ’মাস ধরে কোনও অনুষ্ঠানে ডাক নেই। একটা টাকাও রোজগার না-হলে সংসার কী ভাবে চলে? সেই কথা কি বুঝবে বাচ্চাগুলো?’’

উঠোনে গোবর জল ছড়ান বিকাশের স্ত্রী টুম্পা। তিনি বলেন, ‘‘বাধ্য হয়ে বারান্দায় বিস্কুট, পানের দোকান দিয়েছি। তাতে নুন-ভাতের খরচ ওঠে। কিন্তু বাচ্চাদের পুজোর জামা?’’ গোবর লেপা হাত ধুয়ে এসে টুম্পা বলেন, ‘‘অন্য বার এলে দেখতেন, গ্রামে এখন ঢাকের মহড়া চলছে। ঘরে ঘরে ঢাকের বাজনা।’’ আর এখন? কাঠঠোকরার ঠক ঠক শব্দ জেগে ওঠে নিস্তব্ধ দুপুরে।

প্রতি বছর দশমীর পরের দিন ঘরে ফেরে ঢাকির দল। ঝিনাইবাড়ির উঠোনে আল্পনা আঁকা শুরু হয়, তুলসীতলায় ছড়িয়ে পড়ে হরির লুটের বাতাসা। কারও বাড়িতে নতুন চালের ছাউনি হয়, কোনও উঠোনে দালান ওঠে, দূরে শহরের কলেজে পড়তে যায় কোনও ঢাকির ছেলে বা মেয়ে।

‘‘১৪ বছর থেকে ঢাক বাজাচ্ছি। এত বছরে এই প্রথম পুজোর সময় বাড়িতেই থাকতে হবে।’’ উঠে পড়েন শশীমোহন। বিকেল নামে গ্রামে। ক’দিন পরে এমনই এক বিকেলে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া হবে। সে উড়ে যাবে ঢাকিপাড়ার উপর দিয়ে। শশীমোহনরা ভাবেন, নীলকণ্ঠের ডানায় থাকবে পৃথিবীর অসুখ সেরে ওঠার গল্প। এক নতুন রূপকথা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement