রহিম বক্স লস্কর ও ভারতচন্দ্র হালদার। ডান দিকে, আমপানে ভেঙে পড়া ঘরে রহিম বক্স লস্কর। নিজস্ব চিত্র
ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ
খুব ভোরে ওঠেন, তাই না?
নাতিশীতোষ্ণ এক দুপুর। ফাল্গুনী হাওয়ায় দোদুল্যমান উচ্ছের ফলনের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন বৃদ্ধ ভারতচন্দ্র হালদার। ‘‘চাষবাসের কাজ তো। সারা দিন মাটি মেখে রগড়াতে হয়। খাটনি খুব। ভোর চারটে নাগাদ উঠে পড়ি। ওই যে মসজিদ দেখছ, ওদের আজানেই তো ঘুম ভাঙে আমার।’’ গলায় তুলসীর মালা। বাঁ হাতে সেই মালাটা ঘোরাতে ঘোরাতে পরবর্তী প্রশ্নটা আঁচ করে নিলেন বোধহয়। গলার স্বর খানিক খাদে নামিয়ে বললেন, ‘‘না বাবা, এখানে কিন্তু আমরা ও সব ঝগড়া-মারামারিতে নেই। মিলেমিশেই তো ছিলাম সকলে। এখনও আছি।’’
তাঁকে মনে করানো গেল, আগের দিনই দুই মহারথীর জনসভা ঘিরে তটস্থ ছিল গোটা জেলা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— প্রতিপক্ষকে ছেড়ে কথা বলেননি কেউই। তা হলে হাওয়া কোন দিকে? বৃদ্ধ কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন স্ত্রী জবা, ‘‘লকডাউন আর আমপান আমাদের শেষ করে দিয়েছে, জানো তো। লোকজন এখনও খাবি খাচ্ছে। ভোট নিয়ে কি ভাবার সময় আছে!’’
ডায়মন্ড হারবার লোকাল ধরে মগরাহাট স্টেশনে নামার পরে বার দুয়েক অটো বদল। খর রোদে ‘উন্মুক্ত শৌচবিহীন’ একের পর এক পঞ্চায়েতের অভ্যর্থনা দেখতে দেখতে ঘোর লাগে কিছুটা। এটা ২০২১ সাল না? এখনও ওই শব্দবন্ধই একটি জনপদের অভিজ্ঞান!
মগরাহাট-১ ব্লকের অন্তর্গত ইয়ারপুর পঞ্চায়েতের মহেশ্বরা গ্রামে সে দিন হইহই ব্যাপার। সরস্বতী পুজো উপলক্ষে চলছে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। স্থানীয় ক্লাবঘরে থরে থরে প্রাইজ় সাজানো। কিশোরকুমারের কোনও একটা বাংলা গান বেজে চলেছে মণ্ডপের সামনে রাখা পেল্লায় সাউন্ড বক্সে। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে, সিমেন্টে বাঁধানো সর্পিল পথের দু’পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সরকারি প্রকল্পের টাকায় তৈরি একের পর এক পাকা বাড়ি। যতিচিহ্নের মতো রয়েছে বেশ কিছু পুকুরও। আর রয়েছে আমপানের ক্ষত। দু’পা করে এগোলেই দেখা যায় এক-একটি গাছের দেহাবশেষ।
আপাতদৃষ্টিতে সম্পন্ন এবং বর্ধিষ্ণু একটি গ্রাম। তবে তা শুধু বহিরঙ্গেই। হাঁড়ির খবর নিতে গেলে বেরিয়ে আসে অন্য এক ছবি। জমিজমা থাকলে চাষবাস। না-থাকলে ভরসা বিড়ি বাঁধা, নয়তো রাজমিস্ত্রি বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করা। কলকারখানা তেমন নেই বললেই চলে। অতএব, স্থানীয় স্তরে চাকরি-বাকরিরও তেমন ব্যবস্থা নেই। বছর আটত্রিশের সমীর হালদার ওই গ্রাম থেকে সপ্তাহে তিন দিন কলকাতায় আসেন আনাজ বিক্রি করতে। বাবা ভারতচন্দ্র চাষবাস নিয়েই থাকেন। সমীরের কথায়, ‘‘লকডাউনে তো পুরো ঘরে বসে ছিলাম। তার পরে আমপান এসে খেতের ফলন, গাছপালা সব শেষ করে দিয়ে গিয়েছে। বস্তা বস্তা ভেজা ধান ফেলে দিয়েছি। সেই ধাক্কা এখনও সামলে উঠিনি।’’
মহেশ্বরা থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই মগরাহাট-২ ব্লকের আমড়াতলা পঞ্চায়েতের চাঁদপুর-খানসামাপাড়া গ্রাম। মূলত দরিদ্র সংখ্যালঘুদের বসবাস সেখানে। অলিগলি দিয়ে ভারতচন্দ্রই নিয়ে গেলেন সেই গ্রামে, অশীতিপর বাল্যবন্ধু রহিম বক্স লস্করের বাড়িতে। মাটির দাওয়ার পিছনে সাকুল্যে দু’টি ঘর। তার একটির চাল উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে আমপান। পলিথিন দিয়ে কোনও মতে একটা ছাউনির ব্যবস্থা হয়েছে। রহিম ও তাঁর স্ত্রী নুরজাহান বিবি, দু’জনেই অসুস্থ। রোজগার শূন্য। সরকারি চাল-ছোলা আর ছেলেরাই এখন ভরসা। রহিম বললেন, ‘‘শরীরটা কাজ করার মতো আর নেই। এই যা হোক করে চলে যাচ্ছে। লকডাউনে তো ছেলেরাও বসে ছিল। কী করে যে চলেছে, তা আমরাই জানি!’’ মাথার কাপড় ঠিক করতে করতে চোখ মোছেন নুরজাহান। মৃদু স্বরে বলেন, ‘‘একটু দেখো না বাবা, যদি বার্ধক্য ভাতা-টাতা কিছু দেয় আমাদের।’’
পাশেই বাড়ি রহিমের এক ছেলে মোজাফ্ফর লস্করের। শাড়িতে জরি বসানোর পাশাপাশি অনুষ্ঠানবাড়িতে আইসক্রিমের স্টল দেন তিনি। তিন মেয়ে তাঁর। বড় জন তুহিনা খাতুন মগরাহাট কলেজে ইতিহাসের ফার্স্ট ইয়ার। তিল তিল করে টাকা জমিয়ে কেনা সমস্ত বইখাতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আমপানে। তুহিনার কথায়, ‘‘সারা রাত খোলা আকাশের নীচে কাটিয়েছিলাম। বইখাতা সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ওই রাতের কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।’’ মোজাফ্ফর বললেন, ‘‘যেমন করেই হোক, মেয়েদের পড়াতে চাই। ওরা যত দিন চায়, তত দিনই পড়াশোনা করতে পারে।’’
ভোট আসছে তো। কী চান?
ভারতচন্দ্র, সমীর, রহিম, মোজাফ্ফর, তুহিনা— কারও কাছেই এর স্পষ্ট কোনও উত্তর নেই। জীবন চলে যাচ্ছে এক ভাবে। দারিদ্র আছে, ঝড়ঝাপ্টা আছে, অনিশ্চয়তাও ঘুরঘুর করে চারপাশে— তবু মুখের চিলতে হাসি মলিন হয় না। কী চাইতে হয়, কারওরই বোধহয় ভাল জানা নেই। গ্রামের বাতাসে কান পাতলে যেন শোনা যায় রজনীকান্ত সেনের সেই গান, ‘ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়…।’
দিনান্তের আকাশ ধীরে ধীরে রাঙা হয়ে ওঠে। বিদায় নেওয়ার আগে বন্ধু রহিমের হাত ধরেন ভারতচন্দ্র। সারা দিনের নির্যাস বন্দি হয়ে থাকে দুই বৃদ্ধের ওই ফ্রিজ় ফ্রেমে।