মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
১২ দিনের বিদেশ সফর শেষে কলকাতায় ফিরলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ মমতার বিমান কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করল। কেমন হল সফর? দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘‘সফর সফল। বিনিয়োগ আসছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং দুবাইতে আমরা বাণিজ্য সম্মেলন করেছি। ফিকি এবং ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স সবটা আয়োজন করেছিল। এত সফল কর্মসূচি আমি খুব কম দেখেছি।’’ স্পেনের মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনা, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দুবাই— এই তিন শহর ছিল মুখ্যমন্ত্রীর গন্তব্য। তিন শহরেই পূর্বপরিকল্পনা মতো যাবতীয় কর্মসূচি হয়েছে। তিন শহরে হয়েছে তিনটি শিল্প সম্মেলন। তিন শহরেই প্রবাসী বাঙালি তথা ভারতীয়দের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন মমতা। শুধুমাত্র শিল্প বা লগ্নি আনার বৈঠকই নয়, ফুটবল এবং বইমেলাও মমতার এই সফরে বিশেষ জায়গা পেয়েছে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর দুবাই হয়ে স্পেন রওনা দেন মমতা। ১৩ তারিখ পৌঁছন স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে। কেন তিনি স্পেনকেই বাছলেন, কলকাতা ছাড়ার দিনই তা জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, ‘‘গত বইমেলায় স্পেন ছিল থিম। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, এর পর কোথাও যদি যাই তা হলে ছোট্ট, সুন্দর দেশটায় যাব।’’ মুখ্যমন্ত্রীর সফর-দলে ছিলেন কলকাতা বইমেলার আয়োজক সংগঠন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের দুই কর্তা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এবং শুধাংশু দে। বইয়ের প্রচার, প্রসার, দু’দেশের সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে চিন্তাভাবনা আদানপ্রদান বিষয়ক ‘মউ’ স্বাক্ষর হয়েছে মাদ্রিদে।
মুখ্যমন্ত্রী মাদ্রিদে পৌঁছনোর অব্যবহিত পরেই ইংল্যান্ড থেকে সেখানে পৌঁছন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সৌরভের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ডোনা এবং কন্যা সানা। মাদ্রিদে ক্রিকেট বিগ্রহ সৌরভকে দেখা গেল ভিন্ন দুই ভূমিকায়। এক, লা লিগার সঙ্গে রাজ্য সরকারের মউ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দাদা হয়ে উঠেছিলেন বাংলার ফুটবলের লোক। যে ভাবে তিনি ফুটবলের উন্নতির জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন তা অনেকেরই ধারণার মধ্যে ছিল না। আর দুই, বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে মহারাজ আবির্ভূত হয়েছিলেন বণিক অবতারে। শালবনীতে তাঁর ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার ঘোষণা আলোড়িত করেছে রাজ্যকে।
(বাঁ দিক থেকে) সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, লা লিগার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ার তেভাজ়, স্পেনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীনেশ পট্টনায়েক। —ছবি মমতার ফেসবুক।
মমতার এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যে বিনিয়োগ টানা। সেই সঙ্গে ছিল বাংলার, বাঙালির ফুটবলের উন্নয়ন। লা লিগার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ার তেভাজ় স্বয়ং হাজির ছিলেন মাদ্রিদের অনুষ্ঠানে। এমনিতেই গত দেড় বছর ধরে ভারত তথা বাংলার ফুটবল বাজারে নজর দিয়েছে লা লিগা। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুটবল লিগের মহাকর্তা জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলার ফুটবলের জন্য তাঁরা কাজ করতে আগ্রহী। তার পরেই লা লিগাকে অ্যাকাডেমি করার জন্য যাদবপুর-সন্তোষপুরের কিশোরভারতী স্টেডিয়াম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। মমতার সফর দলে ছিলেন কলকাতার তিন বড় ক্লাব মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডানের কর্তারাও। ইউরোপীয় ফুটবলের অন্যতম শক্তিধর ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাবিউতেও গিয়েছিলেন মমতা। ছিলেন সৌরভও। পরিকাঠামো, ফুটবলের বিপণন দেখে মমতা বলেন, ‘‘এখান থেকে আমরা নতুন আইডিয়া পেলাম।’’ বার্নাবিউর স্টোর থেকে দাদাকে একটি বল উপহার দেন দিদি।
রিয়ালের ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাবিউর গ্যালারিতে মমতা ও সৌরভ। —ছবি মমতার ফেসবুক।
এই সফরে প্রথম বাণিজ্য সম্মেলনটি হয় মাদ্রিদে। সেখানে স্পেনের প্রথম সারির বণিকসভার কর্তারা হাজির ছিলেন। বাংলা কেন এখন বিনিয়োগের জন্য অনুকূল তা স্পেনের শিল্পমহলের সামনে তুলে ধরেন বাংলার শিল্পপতিরাও। ছিলেন হর্ষ নেওটিয়া, তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা, শাশ্বত গোয়েন্কা, আদিত্য আগরওয়াল-সহ অন্যরা। একই ভাবে বার্সেলোনার বাণিজ্য সম্মেলনেও বাংলায় বিনিয়োগের আবেদন জানান মুখ্যমন্ত্রী থেকে শিল্পপতিরা। মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনায় প্রবাসীদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে সতীশ রাই সিঙ্ঘানি নামের এক ব্যবসায়ী মমতাকে কাছে পেয়ে সরাসরি কলকাতায় লগ্নির ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জানান, কলকাতা বা তার আশপাশে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কারখানা গড়তে চান তিনি। যা শুনে মুখ্যমন্ত্রীও আমন্ত্রণ জানান তাঁকে। রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী, শিল্পসচিব বন্দনা যাদব এবং অন্য শিল্পপতিদের একটি প্রতিনিধি দল স্পেনের শহর কনস্ট্যান্টির ট্র্যাভিপোসে অন্যতম রেল কোচ তৈরির সংস্থা মিত্তল গ্রুপের মালিকানাধীন রেল-ওয়ান কারখানা পরিদর্শন করেন।রেলওয়ানের কর্ণধার কমলকুমার মিত্তলও ছিলেন সকলের সঙ্গে। তার পরে কমল ঘোষণা করেন, শিলিগুড়িতে ইথানল তৈরির কারখানা তৈরি করা হবে। সে জন্য বিনিয়োগ করা হবে ১৫০ কোটি টাকা। কারখানাটির উৎপাদন ক্ষমতা হবে দৈনিক দু’লক্ষ লিটার। এ ছাড়াও নিউ জলপাইগুড়িতে একটি নতুন আধুনিক কংক্রিট স্লিপার (যে কংক্রিটের ব্লকের উপর রেললাইন পাতা থাকে) তৈরির কারখানার জন্য ১০০ কোটি বিনিয়োগ করা হবে। স্পেন থেকে আমিরশাহি, মুখ্যমন্ত্রীর তিনটি শিল্প সম্মেলনই সঞ্চালনা করেন তাঁর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
গোটা স্পেন সফরে সেখানে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীনেশ পট্টনায়েকের ভূমিকাও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক। মমতা স্পেন ছাড়ার আগে কাতালোনিয়া সরকারের প্রেসিডেন্ট পেরে আরাগোনেস আই গার্সিয়া শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান মুখ্যমন্ত্রীকে। বুধবার বাংলার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও করেন গার্সিয়া। সেই বৈঠকে একাধিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে বলে রাজ্য সরকার তরফে জানানো হয়। তার মধ্যে রয়েছে মোটরগাড়ি উৎপাদন, পরিবেশ ও মেডিটেক, পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তির মতো ক্ষেত্র।
বৈঠকের পর (বাঁ দিকে থেকে) আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী, পেরে গার্সিয়া, দীনেশ পট্টনায়েক এবং বন্দনা যাদব। —নিজস্ব চিত্র।
বার্সেলোনা থেকে দুবাই পৌঁছন মমতা। সেখানে বাণিজ্য সম্মলেনের আগে দুবাই বন্দর পরিদর্শন করেন মুখ্যসচিব, শিল্প সচিব। ছিলেন দুবাই বন্দরের কর্তারাও। সেখানকার পরিকাঠামো খতিয়ে দেখার পাশাপাশি বাংলার বন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়নের বিষয়েও কথা হয়েছে দু’পক্ষের। দুবাইয়ের বাণিজ্য সম্মেলনে ছিলেন সঞ্জীব গোয়েন্কাও। তিনি বলেন, ‘‘এই মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পড়ে বাংলা বদলে গিয়েছে। তার আগে ৩৪ বছর ধরে বাংলা ভুগেছে। দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, শ্রমিক সমস্যা, লকআউট। কিন্তু গত ১২ বছরে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। এখন একটা কর্মদিবসও নষ্ট হয় না। আইনশৃঙ্খলারও কোনও সমস্যা নেই। চাইলেই মুখ্যমন্ত্রীকে পাওয়া যায়। দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়। আমার অভিজ্ঞতা দারুণ।’’
মরু শহরের বাণিজ্য সম্মেলনের আগে মমতার সঙ্গে বৈঠক হয় লুলু শিল্পগোষ্ঠীর। তারা নিউটাউনে একটি শপিংমল নির্মাণ করবে বলে কথা দিয়েছে। তা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয় আমিরশাহির বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী থানি বন আহমেদ আল জ়েয়াউদির। যাঁকে বাণিজ্য সম্মেলনে ‘কিউট’ বলেন মমতা। বাণিজ্য সম্মেলনে আল জ়েয়াউদি বলেন, ‘‘ভারত-আমিরশাহি বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। জনসংখ্যার বিচারে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে আমরা বিশেষ নজরে দেখছি।’’ পরে দুবাইয়ের প্রবাসীদের সঙ্গে মিলিত হন মমতা। সেখানে পরিবেশিত হয় রাজ্য সঙ্গীত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’। রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে রাজ্য সঙ্গীত ও পয়লা বৈশাখকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করা হবে বলে ঠিক হয়েছে বিধানসভায়। তা ঠিক হওয়ার পর শুক্রবার বিদেশের মাটিতে প্রথম বাজল রাজ্য সঙ্গীত।
আমিরশাহির বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী থানি বিন আহমেদ আল জ়েয়াউদির হাতে নিজের আঁকা ছবি তুলে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। —ছবি মমতার ফেসবুক।
গোটা সফরেই নিজেকে ‘ইন্ডিয়া’র নেত্রী হিসাবে উপস্থাপিত করেছেন মমতা। কখনও বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে ‘ভারতের ধারণা’ তুলে ধরেছেন। কখনও বণিকমহলের সামনে বলেছেন, বাংলায় বিনিয়োগ মানে তা শুধু বাংলাতেই নয়। পাশেই বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি রয়েছে। ফলে সেই বাজারও ধরার সুযোগ রয়েছে। মমতা যে স্পেন ও দুবাইয়ে গিয়ে নিজেকে ‘ইন্ডিয়া’র নেত্রী হিসাবে তুলে ধরবেন, তা বোধহয় ঠিক হয়ে গিয়েছিল যাওয়ার পথে দুবাই বিমানবন্দরেই। হঠাৎই দিদির সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের। সৌজন্যমূলক আলাপচারিতার মাঝেই বিক্রমসিঙ্ঘে মমতার উদ্দেশে বলেন, ‘‘আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’’ মমতা উত্তর দেন, ‘‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’’ এর পরেই বিক্রমসিঙ্ঘের প্রশ্ন ছিল, ‘‘আপনিই কি বিরোধী জোটকে নেতৃত্ব দিতে চলেছেন?’’ প্রতিবেশী দেশের প্রেসিডেন্টের থেকে এমন প্রশ্ন যে আসতে পারে, ভাবনাতেই ছিল না মমতার। উত্তরে ‘ওহ মাই গড’ বলে হাসতে দেখা যায় তাঁকে।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। —সংগৃহীত।
সব মিলিয়ে কিছু লগ্নি, কিছু সমঝোতা এবং অনেকটা প্রত্যাশা নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।