ধর্মতলায় ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।
শুধুই ভোটের ফল নয়। সামগ্রিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে দল এবং জনপ্রতিনিধিত্বে আমূল সংস্কারে হাত দিচ্ছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং তাড়াহুড়ো না করলেও চলতি বছরের মধ্যে তা সেরে ফেলে বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ‘নির্ভার’ হতে চান।
ভোটের ফলের নিরিখে রদবদল সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নে তৃণমূলের অন্দরে সংশয় থাকলেও সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। ধর্মতলায় ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে অভিষেকের এই হুঙ্কারের পরে দলের একাংশের প্রশ্ন, ভোটে হার-জিতের ভিত্তিতে রাজ্যব্যাপী রদবদলের সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবসম্মত? দলীয় সূত্রে খবর, ধারাবাহিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে যে রিপোর্ট তৈরি হয়েছে, তার ভিত্তিতে এই সংস্কারে কোনও বাধা নেই। তবে এটা সর্বব্যাপী কোনও সাধারণ ফর্মুলা নয়। রাজ্যের পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের মতে, “দল চাইলে নির্বাচিত সদস্যদের দেওয়া দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারে।”
লোকসভা ভোটে নিজের এলাকায় পিছিয়ে থাকা দলের পুরসভা ও পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন অভিষেক। প্রশ্ন উঠছে, বিধানসভা বা লোকসভায় ফল খারাপ হলে সর্বত্র শুধু স্থানীয় পঞ্চায়েত বা পুরসভার পদাধিকারীকে দায়ী করা কি যুক্তিগ্রাহ্য? এক নেতার কথায়, “ফল পর্যালোচনার সময়ে সব দিকই খতিয়ে দেখা হয়েছে। সেখানে যুক্তি বা বাস্তবতার অভাব হবে না।” দলের সংশ্লিষ্ট ব্লক বা টাউন সভাপতিদেরও একই বন্ধনীতে রেখেছেন অভিষেক। এক রাজ্য নেতার কথায়, “দল ও নাগরিক পরিষেবায় নিস্পৃহতার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। জায়গাগুলি চিহ্নিত করে পদক্ষেপ হবে।”
স্থানীয় স্তরে জনপ্রতিনিধিদের বড় অংশের কাজকর্মে মানুষের অসন্তোষ আছে। লোকসভা ভোটের আগে দলের একাধিক সমীক্ষায় নাগরিক পরিষেবা, দুর্নীতি, অনিয়মের কথা নজরে এসেছে নেতৃত্বের। অন্তর্ঘাত ও বিরোধী শিবিরে যোগাযোগ নিয়েও দলের হাতে কিছু তথ্য আছে। তাতেও সবাই নিঃসংশয় নন। এক রাজ্য নেতার কথায়, “স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা নেতার অন্তর্ঘাত থাকতে পারে বা সাধারণ ভাবে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা না-ও থাকতে পারে। আবার স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে প্রার্থী নিজের পছন্দে ভোট পরিচালনা করায় ফল খারাপ হতে পারে। লোকসভা ভোটে সর্বভারতীয় রাজনীতিও বড় বিষয়। এ জট খোলা কঠিন!”
যে সব জায়গায় দলের ফল খারাপ হয়েছে, ইতিমধ্যেই সেখানকার একাধিক ভারপ্রাপ্ত নেতার কাজকর্ম চিহ্নিত করেছে তৃণমূল। দলীয় সূত্রে খবর, ভোটের আগেও উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গে একাধিক জায়গায় এমন বেশ কিছু নেতার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। একাধিক জনপ্রতিনিধি, এমনকি মন্ত্রী স্তরের নেতার গতিবিধি বেঁধে দিতে হয়েছিল সংগঠনের স্বার্থে। সে সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই অবস্থায় কে বাদ পড়বেন, সেই হিসাব শুরু হয়েছে। রদবদলে কে দায়িত্ব পেতে পারেন, সক্রিয়তা শুরু হয়েছে তা নিয়েও। সাংগঠনিক স্তরে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পুরসভা, পঞ্চায়েত বা পুরনিগমগুলির নির্বাচিত পদাধিকারীদের বদলের ক্ষেত্রে দল সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে? তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের জবাব, “পরিষেবা নিশ্চিত করতে দল প্রয়োজনীয় যে কোনও ব্যবস্থাই নিতে পারে। দল মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। ভোটের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাই দলের দায়িত্ব।” তাঁর সংযোজন, “নেতৃত্বই ঠিক করবেন, তা কী ভাবে হবে।”
শাসক দলের জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে অভিষেকের হুঁশিয়ারি ঘিরে রাজনৈতিক শিবিরে অবশ্য প্রশ্ন ওঠা অব্যাহত। প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ের মন্তব্য, “বাংলায় এমনিতেই নির্বাচনের নামে প্রহসন চলছে। এই হুঁশিয়ারির মানে হল, যেটুকু বাকি আছে, সেটাও লুট করে নেওয়ার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের চাপ দিচ্ছে তৃণমূল!” ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’র রাজ্য সম্পাদক চঞ্চল চক্রবর্তীর বক্তব্য, “তা হলে এ বার থেকে স্থানীয় স্তরে যে ভাবেই হোক দলকে জেতাতে হবে। এর অর্থ পশ্চিমবঙ্গ থাকবে বিরোধীমুক্ত! এ তো গণতন্ত্রের ধারণা হতে পারে না!”