অনেক কাহিনি প্রতীকের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভোট দেবেন কোনখানে? ‘—’ চিহ্নের মাঝখানে। বাংলায় খুব চেনা নির্বাচনী স্লোগান। লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচন তো বটেই, পঞ্চায়েত ভোটেও অনেক প্রতীক। নানা রকম ভাবে স্বীকৃত দলগুলিকে বাদ দিলে একটি আসনে যত নির্দল বা অস্বীকৃত দলের প্রার্থী, তত রকমের অতিরিক্ত প্রতীক। এমন প্রতীক চালু হওয়ার পিছনে রয়েছে নানান মজার গল্পও।
প্রথমেই জেনে রাখা দরকার, নির্বাচনে প্রতীকের সঙ্গে নিরক্ষরতার গভীর যোগ। স্বাধীনতার পরে যখন দেশে নির্বাচন পদ্ধতি চালু হয়, তখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল খুবই কম। তখন চিন্তার বিষয় হয়ে যায়, কী ভাবে ভোট দেবেন সাধারণ মানুষ? যাঁরা পড়তেই পারেন না, তাঁরা কী করে চিনবেন ব্যালট পেপারে লেখা পছন্দের প্রার্থীর নাম বা পছন্দের দল! সেই সময়েই এর উপায় বার করেন নির্বাচন কমিশনের এক কর্তা এমএস শেঠি। তিনি ১৯৫০ সালে কমিশনে যোগ দেন এবং অবসর গ্রহণ করেন ১৯৯২ সালে।
স্বাধীনতার পরে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫১ সালের শেষ দিকে। তার আগে শেঠি কয়েকটি ছবির পেনসিল স্কেচ তৈরি করেন। এমন কিছুর ছবিই তিনি এঁকেছিলেন যা সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় বা সহজেই দেখা যায় এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য। তার মধ্যে কোদাল, বেলচা যেমন ছিল, তেমনই ছিল ফুল, গাছের পাতা কিংবা উদীয়মান সূর্য। চাকরি জীবনে এমন ১০০টি ছবি শেঠি এঁকেছিলেন। সেগুলি এখনও নির্দল বা নতুন দলের জন্য প্রার্থীদের দেয় নির্বাচন কমিশন। ওই তালিকা থেকেই প্রতীক বেছে নিতে হয় প্রার্থী বা দলগুলিকে।
জাতীয় দল— যেমন কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম নিজস্ব প্রতীকেই লড়তে পারে। আবার তৃণমূল, ফরওয়ার্ড ব্লকের মতো আঞ্চলিক দল নিজের রাজ্যে নিজস্ব প্রতীকে লড়াই করতে পারে। তবে অন্য রাজ্যে লড়াই করতে গেলে একই প্রতীক ব্যবহারের কিছু শর্ত রয়েছে। একটি দলের যে একই প্রতীক বরাবর থাকে না, সে নজিরও রয়েছে ভারতে। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ কংগ্রেস এবং বিজেপি। একেবারে প্রথমে কংগ্রেসের প্রতীক ‘জোড়া বলদ এবং জোয়াল’। পরে কংগ্রেস ভাঙলে ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রতীক হয় ‘গাই-বাছুর’। ১৯৭৭ সালের পর থেকে তাদের স্থায়ী প্রতীক হয় ‘হাত’।
আবার কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদল বিজেপি যখন জনসঙ্ঘ ছিল, তখন তাদের প্রতীক ছিল ‘হাতলওয়ালা প্রদীপ’। এর পর ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির মধ্যে মিশে যাওয়ার পর প্রতীক হয় ‘লাঙল কাঁধে কৃষক’। ১৯৮০ সালে বিজেপির স্থায়ী প্রতীক হয় ‘পদ্ম’।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মও বদল হয়। এখন কংগ্রেস নতুন দল হিসাবে এলে কিন্তু আর ‘হাত’ প্রতীক পেত না। ঠিক যেমন ভাবে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি ‘হাতি’ প্রতীকে লড়তে পারত না। কারণ, বিভিন্ন সংগঠন আপত্তি তোলায় নির্বাচন কমিশন কয়েক বছর আগে ঠিক করে, কোনও পশু বা শরীরের অংশকে আর প্রতীক হিসাবে দেওয়া হবে না। কোনও নতুন দল নির্বাচনে অংশ নিতে গেলে তাদের নির্বাচন কমিশনের তালিকা থেকেই বেছে নিতে হয় প্রতীক। যেমন, তৃণমূল কংগ্রেস ‘ঘাসের উপরে জোড়া ফুল’ বেছে নেয়। এখন যে জাতীয় দলের মর্যাদা পাওয়া আম আদমি পার্টি দেশের সর্বত্র ‘ঝাঁটা’ প্রতীকে লড়ে, সেটা আগে ছিল নৈতিক পার্টির প্রতীক। ২০১২ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় নৈতিক পার্টি একটিও আসন জিততে না পারায় স্থায়ী প্রতীকের স্বীকৃতি হারায়। পরে আবেদন জানালেও নির্বাচন কমিশন আর মান্যতা দেয়নি। কারণ, তত দিনে তা আপের স্থায়ী সম্পত্তি হয়ে গিয়েছে।
ভারতে সাক্ষরতা বেড়েছে। কিন্তু এখনও তা সেই স্তরে পৌঁছায়নি যে, নির্বাচন প্রতীক ছাড়া সম্ভব। আবার এটাও একটা বিষয় যে বড় দলগুলির পরিচয়ও তৈরি হয়ে গিয়েছে প্রতীককে কেন্দ্র করে। গ্রামাঞ্চলের নির্বাচনে নির্বাচনী প্রতীকের গুরুত্ব আরও বেশি। তাই পশ্চিমবঙ্গেও রাজ্য নির্বাচন কমিশন প্রতীকের যে তালিকা তৈরি করেছে তা পুরসভা থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আলাদা। কারণ, শহুরে ভোটারের কাছে ‘উড়োজাহাজ’ যতটা পরিচিত, ততটা গ্রামের মানুষের কাছে না-ও হতে পারে। তেমনই ফারাক রয়েছে প্রতীকের তালিকায়। আবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তালিকা গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা। জেলা পরিষদে ‘ক্রিকেটার’, ‘সিলিং ফ্যান’, ‘লঞ্চ’ প্রতীক থাকলেও গ্রাম পঞ্চায়েতে নেই। সেখানে বরং, ‘রেডিয়ো’, ‘বাল্ব’, ‘আম’, ‘কাঁঠাল’, ‘টিউবওয়েল’ রয়েছে। আবার পঞ্চায়েত সমিতির প্রতীকে ‘মোবাইল ফোন’, ‘অটোরিকশা’ রয়েছে।
প্রতীকের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় নির্বাচন কমিশন খেয়াল রাখে। এমন কিছুর ছবিকেই প্রতীক করা হয় যা, সহজে চেনার মতো সহজে আঁকাও যায়। কমিশনের পক্ষে প্রতীক দেওয়া হয় সাদা-কালো স্কেচ। যাতে তা প্রার্থীরা সহজে আঁকতে বা ছাপতে পারেন।