নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীল। ফাইল চিত্র।
তিনটি ছোট ফ্ল্যাট জোড়া দিয়ে চার শয়নকক্ষের বেশ বড় একটি ফ্ল্যাট। ইডি সূত্রে খবর, তার মালিকানা নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের এক সংস্থার নামে। অথচ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির সূত্রে দাবি, কয়েক বছর আগে হুগলির চুঁচুড়া থানার পিপুলপাতি এলাকায় একটি বহুতল আবাসনের ওই ফ্ল্যাটই ভাড়া নিয়ে থাকতেন রাজ্য পুলিশের আইজি পদের এক অফিসার। তাদের আরও দাবি, এখনও ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়ে বাস করছেন ডিআইজি পদের অন্য এক পুলিশকর্তা।
ইডি সূত্রের বক্তব্য, এ ভাবে উঁচু পদে আসীন দুই পুলিশকর্তার অয়নের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকা এবং তাঁদের সঙ্গে যোগসূত্রের হাতে আসা প্রমাণ আরও বেশি জোরালো করছে একটি প্রশ্নকে। তা হল, অত্যন্ত প্রভাবশালী অয়নের মাথায় কি তবে হাত ছিল ততোধিক প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির?
প্রশ্ন উঠছে, রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালীদের পাশাপাশি পুলিশের কিছু তাবড় কর্তার প্রশ্রয়েই কি অয়নের এত বাড়বাড়ন্ত? বছর চারেক আগে নিয়োগ দুর্নীতি ও প্রতারণার মামলায় সিআইডি-র হাতে গ্রেফতার হয়েও নীলাদ্রি দাস চার্জশিটে অব্যাহতি পাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে যে, পুলিশের উঁচু স্তরে কি তাঁর যোগসাজশ ছিল? এখন প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে একই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে অয়নকে নিয়েও।
নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির যে সব রাজনৈতিক নেতা এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের মাথার উপরে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির ‘স্নেহের হাত’ ছিল বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে অভিযোগ। সেই সব ‘হাত’-এর সন্ধানে নেমেই এ ভাবে পুলিশের সম্ভাব্য প্রভাবশালীদের বিষয়ে সন্দেহ বাড়ছে তদন্তকারীদের।
ইডি সূত্রের দাবি, নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে অয়নের বিরুদ্ধে এর আগে হুগলি জেলায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছিল। কিন্তু কোনও এক ‘জাদুবলে’ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি। অধিকাংশ মামলায় আগাম জামিনে আছেন তিনি। তদন্তকারীদের প্রশ্ন, রাজ্য পুলিশের দুই কর্তার সঙ্গে অয়নের ঘনিষ্ঠতার কারণেই কি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি?
তদন্তকারীদের দাবি, পিপুলপাতির ওই ফ্ল্যাটের ভাড়া রাজ্য সরকারের তরফে দেওয়া হয় বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। ভাড়ার ব্যাপারে অয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্তাদের কী ধরনের চুক্তি হয়েছিল এবং ওই ভাড়া হিসেবে মাসে বা বছরে কত টাকা দেওয়া হত, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইডি-র অভিযোগ, নিয়োগ দুর্নীতির কালো টাকা ওই আবাসনে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। পরে পুলিশকর্তাদের বসবাসের জন্যই তিনটি ফ্ল্যাটকে এক করে একটি বড় ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়। তদন্তকারীদের দাবি, অয়ন অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাঁর সল্টলেকের বাড়ি-অফিস থেকে প্রভাবশালী-যোগের নানান নথি উদ্ধার হয়েছে। কলকাতা হাই কোর্টের সরকারি আইনজীবী, মন্ত্রী ও রাজ্য প্রশাসনের একাধিক প্রভাবশালী অফিসারদের সঙ্গে অয়নের যোগসূত্র মিলেছে। এ বার চুঁচুড়ার ফ্ল্যাট পরের পর পুলিশকর্তাদের ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসা তাই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে তারা।
অয়ন নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় তৃণমূলের সদ্য বহিষ্কৃত জেলবন্দি যুব নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। শান্তনুর মাথার উপরেও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির স্নেহের হাত রয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে ইঙ্গিত। ইডি-র অভিযোগ, কিছু রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকর্তার যোগসূত্রে বেপরোয়া ভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দুর্নীতি চালিয়েছেন শান্তনু ও অয়ন। কলকাতা পুরসভা-সহ রাজ্যের প্রায় ৭০টি পুরসভা এবং রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি দফতরে বেআইনি নিয়োগেও অয়ন যুক্ত বলে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে ইডি।
এক তদন্তকারী অফিসার জানান, অয়নের বিরুদ্ধে প্রতারণার সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগের মামলা ছিল। প্রশ্ন উঠছে, পুলিশকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণেই কি তাঁর বিরুদ্ধে কোনও গুরুতর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি? সব ক্ষেত্রেই ছাড় পেয়েছেন অয়ন? ইডি জানিয়েছে, অয়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার নথি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অয়ন বর্তমানে ইডি-র হেফাজতেই আছেন।