বছর বছর বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনো ডাক্তারদের একটা অংশের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সুপ্রিম কোর্ট। এ ব্যাপারে মূলত মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া বা এমসিআইয়ের নজরদারির দিকেই তাদের আঙুল।
এ বার কেন্দ্রের একটি ছাঁকনি-পরীক্ষার প্রস্তাবে এমবিবিএসের ধার ও ভার নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। এবং এ ক্ষেত্রেও কাঠগড়ায় এমসিআই। কেননা এমবিবিএসের পঠনপাঠন চলে ওই সংস্থার নজরদারিতেই।
কেন্দ্রের প্রস্তাবটি কী?
জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ছাঁকনি পেরিয়ে বছর চারেক পড়ে এমবিবিএস পাশ করলেই এত দিন মিলত রোগী দেখার ছাড়পত্র বা ডাক্তারির লাইসেন্স। (এ বার থেকে অবশ্য দেশ জুড়ে অভিন্ন মেডিক্যাল প্রবেশিকা হবে কেন্দ্রীয় স্তরে)। কিন্তু কেন্দ্রের প্রস্তাবিত নতুন ব্যবস্থায় এমবিবিএস পাশ করলেই আর ডাক্তারির লাইসেন্স মিলবে না। ওই ছাড়পত্র পেতে হলে এমবিবিএসের পরে আরও একটি ছাঁকনি-পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেই পরীক্ষার পোশাকি নাম ‘ন্যাশনাল এগ্জিট টেস্ট’ বা নেক্সট।
বিষয়টি এখনও খসড়া বিলের স্তরে আছে। তবে অচিরেই এই নিয়ে আনা হবে বিল। এবং সেটি আইনে রূপান্তরিত হলেই পাকাপোক্ত ভাবে নতুন পরীক্ষা চালু হয়ে যাবে। সেই সম্ভাবনাতেই প্রশ্ন ও বিতর্ক তুলছে সংশ্লিষ্ট মহল। ডাক্তারি শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, এটা এমবিবিএস ডিগ্রিটার অপমান, এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারদের অপমান। মেডিক্যালের পঠনপাঠন নিয়ে এমসিআই যদি আগেই কড়া মনোভাব দেখাত, তা হলে এমন ‘অপমানজনক’ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না হবু ডাক্তারদের।
কী করতে চাইছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক?
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিল (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৬’-র একটি খসড়া তৈরি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, এমবিবিএস পরীক্ষার পরেও নেক্সট নামে একটি পরীক্ষা পাশ করতে হবে সব হবু ডাক্তারকে। তবেই মিলবে ডাক্তারি করার লাইসেন্স। আবার এর ভিত্তিতেই পরবর্তী কালে নির্ধারিত হবে, কোনও ছাত্র বা ছাত্রী মেডিক্যালের স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হতে পারবেন কি না।
ডাক্তারি শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, এর অর্থ, সরকার নিজেরাই এমবিবিএস পঠনপাঠনে এমসিআইয়ের নজরদারির উপরে আর আস্থা রাখতে পারছে না। তাই তারা নতুন ছাঁকনি-পরীক্ষা চালু করতে চাইছে। অথচ তারাই তো এমসিআইকে ডাক্তারির পাঠ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়েছিল। এখন সেই সংস্থার উপরে অনাস্থা কেন? এতে কি শীর্ষ আদালতের বক্তব্যেই সিলমোহর লাগানো হচ্ছে না? এটাই কি স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে না যে, এমবিবিএস পাশ করা অনেকের যোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের ব্যাখ্যা, এমসিআইয়ের নজরদারির অভাবেই এমবিবিএস পঠনপাঠনের মান সর্বত্র ঠিক রাখা যায়নি। এমবিবিএস পরীক্ষাও সর্বত্র নিরপেক্ষ ভাবে হয় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক তাই মনে করছে, এমবিবিএসকে যোগ্যতামান ধরে ডাক্তারদের লাইসেন্স দেওয়া ঠিক হবে না। নতুন কোনও একটা বাছাই-প্রক্রিয়া বা ছাঁকনি দরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মেডিক্যাল শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব অরুণ সিঙ্ঘল বলেছেন, ‘‘যতটা যাচাই করে ডাক্তারদের লাইসেন্স দেওয়া যায়, ততই ভাল। চিকিৎসকদের মানের উপরেই তো মানুষের জীবন নির্ভর করে। তাই এগ্জিট টেস্টের কথা ভাবা হয়েছে।’’
কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত কি এমসিআইয়ের প্রতি অনাস্থা নয়?
‘‘তা নয়। আসলে ডাক্তারদের যোগ্যতা বা মান যাতে আরও নিশ্চিত করা যায়, তার জন্য আরও পরীক্ষার কথা ভাবা হয়েছে,’’ জবাব এমসিআইয়ের সচিব রিনা নায়ারের। এমসিআইয়েরই গ্রিভান্স সেলের চেয়ারম্যান অজয় কুমার কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা তুলে ধরেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, মুখে না-বললেও মূলত কিছু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের পঠনপাঠন ও পরীক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে চিন্তায় পড়েই স্বাস্থ্য মন্ত্রক এই নতুন নিয়ম করতে চাইছে। ‘‘স্বাস্থ্য মন্ত্রক বরং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজকে ছাড়পত্র দেওয়া বন্ধ করে দিক। তা হলে আর কোনও প্রশ্ন উঠবে না,’’ বলছেন গ্রিভান্স সেলের চেয়ারম্যান।
এমসিআইয়ের কারিকুলাম কমিটির প্রাক্তন সদস্য তথা পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করছেন, এগ্জিট টেস্টের প্রস্তাব দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রক মেনে নিচ্ছে যে, এমবিবিএসের পঠনপাঠন ও পরীক্ষা-পদ্ধতিতে বিস্তর গোঁজামিল রয়েছে। ‘‘হয় এর পরে মন্ত্রক মেডিক্যাল কলেজগুলিতে এমসিআইয়ের পরিদর্শন বন্ধ করুক অথবা এগজিট টেস্টের প্রস্তাব থেকে সরে আসুক। দু’টো একসঙ্গে চলতে পারে না,’’ বলছেন অমিতবাবু।
মেডিক্যাল কলেজগুলোর পঠনপাঠনের মানে যে ঘাটতি থাকছে, নতুন ছাঁকনি-পরীক্ষার প্রস্তাব দিয়ে মন্ত্রক সেটা মেনে নিচ্ছে বলে মনে করেন এমসিআইয়ের প্রাক্তন সদস্য চিকিৎসক প্রদীপ মিত্রও। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘স্বাস্থ্য মন্ত্রক সেই দিকটা জোরদার করার চেষ্টা চালাচ্ছে না কেন?’’
উত্তরে নীরব স্বাস্থ্য মন্ত্রক।