(বাঁ দিকে) জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (ডান দিকে)। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
বহু দিন পরে কলকাতার রাজপথে আবার ‘কমরেড’ শব্দটা এই ডেসিবেলে শোনা যাচ্ছে। তাই না?
রবীন দেব একটু কি ভাবলেন? একটা ন্যানো সেকেন্ড? তার পরে বললেন, ‘‘আলোড়নটা দেখেছেন? আমার কাছে তো হোয়াট্সঅ্যাপ আসছে, বুদ্ধ’দার স্মরণসভা ব্রিগেডে করুন। নইলে ভিড় সামলাতে পারবেন না!’’
শ্রাবণ-দুপুরের ঠা-ঠা রোদ। ছুরির মতো বিঁধছে গায়ে-মাথায়। মৌলালি থেকে পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত এজেসি বোস রোডের দক্ষিণমুখী রাস্তার দখল নিয়ে নিয়েছে ঘর্মাক্ত সিপিএম জনতা। থিকথিক করছে লোক। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের এক তলার চত্বরে শায়িত তাঁর নশ্বর দেহ। বাইরে দীর্ঘ, দীর্ঘ লাইন। মানুষের সেই সারি চলে গিয়েছে সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের সদর দফতর দীনেশ মজুমদার ভবন পর্যন্ত। সেখান থেকে যে লাইন শুরু হয়েছে, তার লেজ গিয়ে পড়েছে মৌলালির কাছে এসএন ব্যানার্জি রোডে।
ঘন ঘন ‘অমর রহে’, ‘ভুলছি না, ভুলব না’, ‘লাল, লাল, লাল সেলাম’-এর গর্জনের ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে শুক্রবার সন্ধ্যা নামার খানিক আগে কাচের শকটে বাহিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চির দিনের মতো ইতিহাস হয়ে গেলেন।
দেখতে দেখতে অবধারিত ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারির কথা মনে পড়ছিল। ১৪ বছর আগের সে দিনের শেষযাত্রায় থাকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে এ দিনের শেষযাত্রায় থাকার তুল্যমূল্য অভিজ্ঞতার কৌতূহল নিরসনেই যাওয়া।
সে দিন কলকাতা শহরের বিভিন্ন রাজপথের দখল নিয়েছিল বামজনতা। শেষযাত্রায় লোকান্তরে চলে গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। বুদ্ধদেবের মতো তিনিও মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। বসুর দেহ দান করা হয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতালে। বুদ্ধদেবের এনআরএসে। বসুর বিদায় হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে শুরু হয়েছিল শেষযাত্রা। জাতীয় পতাকায় মোড়া বসুর দেহ বাহিত হয়েছিল সেনাবাহিনীর সজ্জিত ‘গান ক্যারেজে’। মোহরকুঞ্জে রাজ্য পুলিশের ২১ তোপধ্বনির পরে সেই ফৌজি শকট চলে গিয়েছিল নিকটবর্তী হাসপাতালে।
বুদ্ধদেবের অন্তিম বাহন হয়ে রইল তাঁর যাপনের মতোই সাদামাঠা একটি শববাহী শকট। কর্মক্ষম অবস্থায় তিনি একটি সাদা বুলেট-নিরোধক অ্যাম্বাসেডরে চড়ে আলিমুদ্দিনে যাতায়াত করতেন। সরকারি সেই গাড়ির নম্বর ‘ডব্লিউ বি ০৬ ০০০২’। সে গাড়ির চাকা শুক্রবার থমকে রইল দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে। আলিমুদ্দিন থেকে বুদ্ধদেব বেরোলেন যে গাড়িতে, সেটি একটি বেসরকারি সংস্থার। নম্বর ‘ডব্লিউ বি ২৫এল ৭৮৭৮’। আলিমুদ্দিন থেকে সেই গাড়িতেই বুদ্ধদেব চলে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বসুর শেষযাত্রায় বাংলাদেশ বায়ুসেনার বিশেষ বিমানে কলকাতায় এসেছিলেন শেখ হাসিনা। এসেছিলেন সনিয়া গান্ধী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, প্রণব মুখোপাধ্যায়েরা। বুদ্ধদেবের শেষযাত্রায় হাঁটলেন বিমান বসু, মানিক সরকার, প্রকাশ কারাট, বৃন্দা কারাটেরা। শকটের একেবারে সামনে আগাগোড়া হাঁটলেন ঘামে জবজবে মহম্মদ সেলিম। শববাহী গাড়ির পিছনের একটি এসইউভি-র পিছনের আসনে নিথর বসে রইলেন মীরা ভট্টাচার্য। দলের নেতাদের সঙ্গে শোকমিছিলে পা মেলালেন বুদ্ধদেবের সন্তান সুচেতন ভট্টাচার্য। তাঁর সঙ্গে হাঁটলেন প্রয়াত শ্যামল চক্রবর্তীর কন্যা উষসী চক্রবর্তী। খানিকটা আগে ছাত্রনেত্রী দীপ্সিতা ধর। তাঁদের কণ্ঠে স্লোগান, ‘রেড রেড রেড স্যালুট কমরেড’।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, মাত্রই ১৪টি বছর। কিন্তু কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! বসুর শেষযাত্রা ছিল বর্ণাঢ্য। জৌলুসে মোড়া। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মতো। সংগঠিত ভিড়ের জন-কুর্নিশে। বুদ্ধদেবের শেষযাত্রা হল জৌলুসহীন। খানিকটা ট্র্যাজিক নায়কের মতো। খানিকটা তাঁর দু’কামরার ফ্ল্যাটের মতো। কিছু খালি গলায় ‘ইন্টারন্যাশনাল’। কোথাও কোথাও ঠাসবুনোট, আবার কোথাও কোথাও ছানা-কাটা ভিড়ে।
কারণ, জীবন গিয়াছে চলে ১৪টি বছরের পার। তখন সিপিএম ক্ষমতাসীন। এখন সিপিএম ক্ষমতাহীন। ২০১০ সালে ২৩৫টি আসন নিয়ে রাজ্যের ক্ষমতায় দোর্দণ্ডপ্রতাপ বামফ্রন্ট। নেতৃত্বে দোর্দণ্ডতর প্রতাপ সমন্বিত সিপিএম। ২০২৪ সালে সিপিএম রাজ্যের ক্ষমতার ধারেপাশেও নেই। বিধানসভা এবং লোকসভায় এ রাজ্যে তারা শূন্য। পালাবদল ঘটে গিয়েছে ক্ষমতার অলিন্দে। তার অমোঘ ছাপ বামদুর্গের শেষ অধিপতির অন্তিমযাত্রায়।
বসুর শেষযাত্রা শুরু হয়েছিল ‘পিস হাভেন’ থেকে। সকাল সাড়ে ৭টায়। প্রথম বিরতি ছিল আলিমুদ্দিনে। কিন্তু অপরিসর গলিতে অত বড় গাড়ি ঢুকতে পারেনি। স্ট্রেচারে শায়িত বসুকে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্যেরা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন পার্টি অফিসের চত্বরে। সিপিএম এবং বামফ্রন্টের প্রবীণ নেতারাই শুধু বসুকে মালা দিয়েছিলেন সেখানে। সকাল ৯টার কিছু পরে বসুর দেহ তোলা হয়েছিল বিশাল ট্যাবলো লরিতে। সেই লরির পাশে পাশে ঝকঝকে মোটর সাইকেলে কলকাতা পুলিশের সার্জেন্টরা। বসুর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর আপ্ত সহায়ক জয়কৃষ্ণ ঘোষ এবং তখন সদ্য পঞ্চাশ-পেরোনো সেলিম। সটান মহাকরণের পথে। সকাল ১০টায় মহাকরণে মালা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তৎকালীন মুখ্যসচিব। সেখান থেকে মাইলটাক দূরের বিধানসভা ভবনে। গাড়ি-দূরত্বে পাঁচ মিনিটের ওইটুকু পথ যেতে লেগেছিল আধ ঘণ্টারও বেশি। বেলা পৌনে ১১টা থেকে পৌনে ৪টে পর্যন্ত বিধানসভায় শায়িত ছিলেন বসু। সেখানেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন হাসিনা, সনিয়া, আডবাণী, প্রণবেরা। তাঁদের পরে কাতারে কাতারে সাধারণ মানুষ। বেলা ৩টেয় বন্ধ হয়েছিল বিধানসভার ফটক। বাইরে তখনও থিকথিক করছে মানুষ। বেলা পৌনে ৪টের সময় সেনা তত্ত্বাবধানে সুসজ্জিত ফৌজি শকটে বসুর দেহ রওনা হয়েছিল মোহরকুঞ্জের পথে। তত ক্ষণে গোটা মধ্য কলকাতা জনতার দখলে। জনজোয়ার ঠেলে মোহরকুঞ্জে। সেখানে ভিড়ে-ঠাসা মেকশিফ্ট গ্যালারির সামনে ‘গান স্যালুট’ রাজ্য পুলিশের। বসুর দেহদানের অঙ্গীকারপত্র দেওয়া হয়েছিল বিমানকে। সেখান থেকে সোজা এসএসকেএমের অ্যানাটমি বিভাগে।
শুক্রবার বুদ্ধবাবুর শেষযাত্রা শুরু হল ‘পিস ওয়ার্ল্ড’ থেকে। কাচ-ঢাকা সাধারণ শকটে লাল ঝান্ডায় মোড়া তাঁর দেহ বার করা হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। সেখান থেকে সোজা বিধানসভা। কোনও আড়ম্বর নেই। ভিড়ভাট্টা নেই। সাদামাঠা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন রাজ্যের মন্ত্রী, শাসক এবং বিরোধী দলের বিধায়কদের। বেলা ১১টা থেকে যে আধ ঘণ্টা বুদ্ধদেবকে রাখা হয়েছিল বিধানসভায়, তত ক্ষণই ঠায় সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। ঘটনাচক্রে, সেখানেই শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন একদা বুদ্ধদেবের স্নেহভাজন সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদ এবং অধুনা তৃণমূলের শ্রমিকনেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ১২টার কিছু পরে বেরিয়ে আলিমুদ্দিনে।
সেখানে অবশ্য ভিড় ভেঙে পড়েছিল। যে ভিড়ের মধ্যে ইতস্তত ঘুরতে দেখা গেল অভিনেতা রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে। দেখা গেল রাজ্যের প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানকে। কংগ্রেসের নেতা অমিতাভ চক্রবর্তী এবং কলকাতা পুরসভায় কংগ্রেসের সবেধন নীলমণি সন্তোষ পাঠককে সঙ্গে নিয়ে শেষ নমস্কার জানাতে এসেছিলেন মান্নান। প্রাক্তন অঙ্কের মাস্টারমশাই বলছিলেন, ‘‘ঝগড়া ছিল। কিন্তু যুক্তি দিয়ে কথা বললে শুনতেনও।’’
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মুখে এজেসি বোস রোডের উপর একচিলতে মঞ্চ। সেখান থেকেই মাইক্রোফোন-হাতে ভিড় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন কখনও মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, কখনও মধুজা সেনরায়, কখনও সংগ্রাম চট্টোপাধ্যায়রা। সঙ্কীর্ণ গলিতে ঠাসাঠাসি মানুষ। তাঁদের কারও হাতে পোস্টার। কারও হাতে ফুলের তোড়া। কেউ একেবারেই শূন্য হাতে। দীর্ঘ ১৪ বছর রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। কিন্তু তা-ও এক রাতের মধ্যে ব্যানার, পোস্টার এবং বুদ্ধদেবের ছবি-আঁকা কাগজের ব্যাজ তৈরি করে ফেলেছিল সিপিএম। রাস্তার উপর পসরা বসেছিল কাস্তে-হাতুড়ি আর বুদ্ধদেবের ছবি সম্বলিত কি-রিংয়ের। খুব একটা বিকোতে দেখলাম না অবশ্য।
বেলা সওয়া ৩টে নাগাদ শেষ বারের মতো আলিমুদ্দিন থেকে বেরোলেন বুদ্ধদেব। একেবারে প্রথমে দু’টি অর্ধনমিত লালঝান্ডা বাঁধা একটি অটো রিকশা! তার পরে ৮০ জন স্বেচ্ছাসেবকের সারি। প্রত্যেকের হাতেই অর্ধনমিত লালঝান্ডা। তাঁদের পিছনে এক থোকা ভিড়। তারও পিছনে সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের অর্ধনমিত ঝান্ডা-হাতে সারিবদ্ধ কর্মীরা। তারও পিছনে আসছিলেন বুদ্ধদেব। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল শকটের মাথায় ঝলমল করে জ্বলছে লাল-নীল-হলদেটে ‘বিকন লাইট’। গাড়ির কাচের ছাদে কালো রঙের পটভূমিকায় বুদ্ধদেবের হাসিমুখ পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা কাছে যেতে পারেননি, তাঁদের কেউ কেউ ভিড়ের মধ্য থেকে ছুড়ে দিচ্ছিলেন রজনীগন্ধার মালা। জমতে জমতে ফুলের সেই স্তূপ খানিক ছায়া দিচ্ছিল নিষ্প্রাণ নেতার মুখমণ্ডলে।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে বুদ্ধদেবকে নামানোর কথা ছিল। ভিড়ের চাপে তা করে ওঠা যায়নি। সময়ও গড়িয়ে যাচ্ছিল। বারংবার ঘোষণা হচ্ছিল, বিকেল ৪টের মধ্যে এনআরএস পৌঁছতে হবে শেষযাত্রা। যা শেষমেশ পৌঁছল বিকেল ৫টায়। গাড়িতে সাধারণ দিনে জট ঠেলে হলেও যে পথ মিনিট দশেকে পৌঁছনো যায়, সেই পথ অতিক্রম করতে লাগল পৌনে দু’ঘণ্টা।
বিকেল ৫টা ৩ মিনিটে এনআরএসের ফটক পেরিয়ে ঢুকে গেল শববাহী শকট। মনে পড়ছিল, আলিমুদ্দিনের সরু গলিটি দিয়ে যখন বেরোচ্ছিল গাড়িটি, মাইক্রোফোনে ঘোষণা হচ্ছিল, ‘‘আপনারা হুড়োহুড়ি করবেন না। দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।’’ তার কিছু পরে এক মধ্যবয়সিনী ডুকরে উঠে আকুল চিৎকার করছিলেন, ‘‘বামফ্রন্টকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও কমরেড। ২০২৬ সালে বামফ্রন্টকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও!’’
মনে হচ্ছিল, ঘটে যাবে নয়। দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আসন শূন্য করে চলে গিয়েছেন সিপিএমের শেষ বিগ্রহ।