Buddhadeb Bhattacharjee Passes Away

আমি? জ্যোতিবাবুর ওই চেয়ারে? সম্ভাবনাই নেই! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন আমাকে

বুদ্ধবাবু যখন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসলেন, সারা বিশ্বে তখন ইতিহাসের চাকা বামপন্থার বিপরীতে ঘুরতে শুরু করেছে। বামপন্থা তখন বাতিলের খাতায়।

Advertisement

আশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৪ ১১:৩৮
Share:

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রী হন, তাঁর সামনে একাধিক অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানোর চ্যালেঞ্জ ছিল। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

২০০০ সালে যখন জ্যোতি বসুর হাত থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার গ্রহণ করেন, তখন তাঁর সামনে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানোর চ্যালেঞ্জ ছিল। অথবা একাধিক অসম্ভবকে সম্ভব করার কথা ছিল। তিনি সে সব কাজকে সম্ভব করার দায়িত্বটা নিয়েছিলেন। সম্ভবত সেই কারণেই তাঁকে মনে রাখার প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসে।

Advertisement

কার্যভার নেওয়ার পর এত কিছু পরিবর্তন করার ছিল যে, তাকে ‘সংস্কার’ বললেই ঠিক হবে। দীর্ঘ বামশাসনে তাদের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতিগুলো এবং ভূমিসংস্কার বা পঞ্চায়েতি রাজের মতো গণক্ষমতায়নমুখী দাবিগুলো পূরণ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সে সব সংস্কারের ফল কতটা দীর্ঘমেয়াদি হয়েছিল, তা নিয়ে সেগুলির একদা সমর্থকদের মধ্যেই বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তখন পশ্চিমবঙ্গ এমন এক চেহারায়, যে সেখানে নতুন কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কি বাংলায় পরিবর্তন আনতে পারবেন? অথবা বাংলা সম্পর্কিত নেতিবাচক ধারণাকে বদলাতে পারবেন? এই প্রশ্নের জবাবে বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকের অভিমতই ছিল নেতিবাচক। উনি পারবেন না।

Advertisement

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কি অস্বাভাবিক বেকারত্ব দূর করতে বাংলায় শিল্প তথা বিনিয়োগকে আবার সম্ভব করে তুলতে পারবেন?

কেন বাংলা থেকে শিল্পপুঁজি অন্তর্হিত হল— এই ঐতিহাসিক প্রশ্নের পিছনে বিভিন্ন কারণ ছিল। যার মধ্যে সিপিএমের জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ছিল অন্যতম। বিশেষত, মাঝারি মাপের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে।

তৃতীয় যে চ্যালেঞ্জটি বুদ্ধদেবের পক্ষে নিশ্চিত ভাবে অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল (অথচ সেটাই ছিল সব থেকে বড় কাজ), তা হল দলীয় স্তরে পরিবর্তন। দলের ভিতরে এমন পরিবর্তন, যা তাঁকে তাঁর অন্যান্য অভীষ্ট কাজগুলো করে ওঠার মতো পরিবেশ তৈরি করে। তখন বিশ্বের সর্বত্র কমিউনিস্ট পার্টিগুলো মার্ক্সীয় ভাবনায় বদলের কথা ভাবছে। কিন্তু যখনই তাদের নিজেদের ভিতরের পরিবর্তনের প্রসঙ্গ আসছে, দেখা যাচ্ছে তারা গড়িমসি করছে। সন্দেহবাদীরা বলতে শুরু করেছেন, কয়লা শত ধুলেও ময়লা যায় না।

এ সব চ্যালেঞ্জের পরেও ছিল আর একটা বিষয়— সারা বিশ্বে তখন ইতিহাসের চাকা বামপন্থার বিপরীতে ঘুরতে শুরু করেছে। ভারতে দ্বীপের মতো জেগে আছে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, ক্ষুদ্র ত্রিপুরা এবং দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজাত ক্যাম্পাস । সেই ঐতিহাসিক স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব তাঁর মিশন সফল করার জন্য কোন আশাই বা রাখতে পারেন! বামপন্থা তো তখন বাতিলের খাতায়। শুধু তার সনাতন বিরোধীদের নিরিখেই নয়, বিশ্বের একটা বৃহৎ জনসংখ্যা তখন বামপন্থাকে ত্যাজ্য করেছে।

একটু নিবিড় ভাবে দেখলে বোঝা যায়, শুধু তাঁর দলের নয়, বুদ্ধদেবের নিজেকেও বদলানোর দরকার ছিল। ‘পরিবর্তন’ শব্দটা বোধ হয় ঠিক হল না। বরং বলা যাক, তাঁর নিজেকে ‘পুনরাবিষ্কার’ করার প্রয়োজন ছিল। বুদ্ধদেব এবং তাঁর ১০ বছরের শাসনকাল নিয়ে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর কাজটা করতে চেয়েছিলেন। এই মাপের আন্তরিকতা ভারতীয় রাজনীতিকদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না।

সবশেষে বলা চ্যালেঞ্জটাকে সবচেয়ে প্রথমে বিচার করতে গেলে দেখা যাবে, জ্যোতি বসুর আমলের শেষ দিকে সাংবাদিকদের অন্যতম নিয়মিত আলোচনার বিষয় ছিল— জ্যোতিবাবুর পরে কে। তখন আমি দিল্লির একটি কাগজে কাজ করতাম। সেখানে আমাকে এমনই একটি নিবন্ধ লিখতে বলা হয়েছিল। মনে আছে, তখন আমাকে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, “কে? আমি?ওই চেয়ারে? কোনও সম্ভাবনাই নেই!” সেই সঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, জ্যোতিবাবুর জায়গায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ই সব থেকে যোগ্য লোক হতে পারেন।

কিন্তু কেন বুদ্ধদেব জ্যোতিবাবুর চেয়ারে বসতে চাননি? যতই হোক, জ্যোতিবাবুর মন্ত্রিসভায় গুরুত্বের দিক থেকে তিনিই ছিলেন দু’নম্বর। বছরের পর বছর ধরে দল তাঁকে সেই ভূমিকার জন্য লালন করেছে। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় জ্যোতিবাবুর ঘনিষ্ঠ হতে পারেন। কিন্তু তাঁর আসনে বসার মতো যথেষ্ট দলীয় প্রেক্ষিত তাঁর ছিল না।

আমার প্রশ্নের জবাবে বুদ্ধদেবের বক্তব্যে খানিকটা ঠাট্টার সুর ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। হয়তো তাঁর পক্ষে ওই পদে নিজেকে কল্পনা করাটা অবিশ্বাস্য ছিল। তিনি বলেছিলেন, “ওই চেয়ারে বসতে গেলে যাবতীয় রকমের আপস করতে হয়। ওই পদ যেমনটা চায়, তেমন ভাবে আমি পুঁজিপতিদের সঙ্গে তাল দিতে পারব না।”

এর মানে অবশ্য এটা নয় যে, তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত বিনয় দেখাচ্ছিলেন বা ভান করছিলেন। বুদ্ধদেবের জীবনের দিকে নজর করলে বোঝা যায় পুঁজিপতিদের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর লোক তিনি সত্যিই ছিলেন না। নাটক বা কবিতা নিয়ে লেখালিখি করতে বা আড্ডা দিতেই তিনি ভালবাসতেন। মার্ক্স, মায়াকোভস্কি, মার্কেজই তাঁকে বেশি উজ্জীবিত করতেন। তাঁর কাছে কাঞ্চন ছিল পরিহার্য। সে দিক থেকে দেখলে তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই সেই জাতের বাঙালি ভদ্রলোক, যিনি পুঁজির মার্ক্সীয় তত্ত্ব যতটা ভাল করে জানতেন, পুঁজি বাস্তবে কী ভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে ততটা ওয়াকিবহাল নন।

কিন্তু এ সব সত্ত্বেও পরিবর্তন ঘটল। বুদ্ধদেব যখন পুঁজিপতিদের কাছে পৌঁছলেন, তাঁরা সদর্থক ভাবেই সাড়া দিলেন। সব সময়ে হয়তো বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগ আসেনি। কিন্তু পুঁজিপতিরা তাঁর প্রতি নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। তাঁর নিজের পরিবর্তন ছিল তাঁর রাজনীতিরই অঙ্গ। এমন নয় যে, তিনি হঠাৎ করে একদিন পুঁজির এ যাবৎ অজ্ঞাত সব গুণাবলি আবিষ্কার করে ফেললেন। তর্কের খাতিরে তিনি লেনিনকে উদ্ধৃত করে বলতেই পারতেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্‌-শর্তই হল বুর্জোয়া বিপ্লব বা শিল্পবিপ্লব। কিন্তু তিনি জানতেন, দেশবিদেশের বিনিয়োগকর্তাদের মন জয় করা ছাড়া তাঁর সামনে রাজ্যের বেকার সমস্যার সমাধানের অন্য কোনও পথ খোলা নেই। রাজ্যে বামশাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সেটাই একমাত্র পথ। প্রয়োজনের বিন্দুতে দাঁড়িয়েই তিনি ভাবনাচিন্তা করেছিলেন।

মনে পড়ছে, বুদ্ধদেব খুব আবেগের সঙ্গে বিনিয়োগের প্রস্তাবগুলোর কথা বলতেন। মনে করতেন তিনি সেগুলো বাস্তবায়িত করতে পারবেন। পুঁজিপতিরাও যে ওই পরিবর্তনকে খুব বাস্তব বলে বুঝেছিলেন, তা নয়। কিন্তু তাঁরা এটুকু বুঝেছিলেন যে, মানুষটি অকপট এবং এঁকে বিশ্বাস করা যায়। আমি বুদ্ধদেবের জাকার্তা সফরে সঙ্গী ছিলাম। সেখানে তিনি সালেম গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলায় কিছু প্রকল্পের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি ‘মউ’ স্বাক্ষর করেন। সইয়ের পর উদ্ভাসিত মুখে বুদ্ধদেবের উক্তি ছিল, “এটা আমার জীবনের সব থেকে আনন্দের দিন।” ইন্দোনেশিয়ায় ঘটে যাওয়া কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের গণহত্যার যে প্রতিবাদ একদা ভারতের কমিউনিস্টরা করেছিলেন, তার থেকে বহু দূরে ছিল সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ।

আরও একটি বিষয়ে তাঁর সেই উদ্দীপনা শেষ পর্যন্ত নিষ্ফল হয়েছি। অত্যন্ত উৎসাহ বুদ্ধদেব ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের জয়ের পর রতন টাটার অভিনন্দনবার্তার কথা বলেছিলেন।

একদা-সন্দিহান পুঁজিপতিদের একাংশের মন তিনি জয় করতে পেরেছিলেন, একথা অনস্বীকার্য। এমনকি, বেশ কিছু বিদেশি গণমাধ্যম-সহ জাতীয় মিডিয়াও তাঁকে বাংলার নতুন ভরসাস্থল হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। চিনের এক সময়ের অবিসংবাদী নেতা দেং জিয়াও পিংয়ের সঙ্গেও তাঁর তুলনা উঠে আসত।

কিন্তু নিজের দলের অভ্যন্তরে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে তাঁর সাফল্য ততটা দেখা যায়নি। বুদ্ধদেব সিটুর জঙ্গি মনোভাবকে প্রশমিত করতে চেয়েছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে দলের ভূমিকায় স্বচ্ছতা আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি দলে ‘একা কুম্ভ’ হয়েই থেকে যান। দলের অনেক বর্ষীয়ান সদস্য বুদ্ধদেবকে নিরস্ত করতে জ্যোতিবাবুর সাহায্য চাওয়া শুরু করেন।

তিন দশকের দীর্ঘ শাসন দলের জীবনীশক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলেছিল। ‘পরিবর্তিত’ বুদ্ধদেবের পক্ষেও নাটকীয় ভাবে তার সংস্কার সম্ভব ছিল না। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, তিনি নিজেও দলের পচনশীল অবস্থার একটি অঙ্গে পরিণত হয়েছিলেন। দলের খোলনলচে বদলানো মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। যদিও বুদ্ধদেব সততার সঙ্গেই তা করতে চেয়েছিলেন।

দিল্লিতে বসে থাকা পার্টিকর্তাদের সঙ্গেও তাঁর সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। যখন তাঁর দল ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে, তখন হেনরি কিসিঞ্জার ও আমেরিকান ট্রেজারি সেক্রেটারি হেনরি পলসন বুদ্ধদেবের সঙ্গে কলকাতায় দেখা করে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, যাতে তিনি তাঁর দলকে ওই চুক্তি সমর্থনে রাজি করান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কাজে বুদ্ধদেব সফল হননি। তাঁর দল সেই ইস্যুতেই ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয়।

ওই চুক্তির প্রসঙ্গ বাদ দিলেও বুদ্ধদেব এবং কিসিঞ্জারের আলোচনা ‘বাঙালি কমিউনিস্ট’-এর চিরায়ত ভাবমূর্তিতে একটা বদল চিহ্নিত করছিলই। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধে তাঁদের ভূমিকার ব্যাপারে কিসিঞ্জার এবং রবার্ট ম্যাকনামারা ছিলেন বাঙালি কমিউনিস্টদের কাছে সব থেকে ঘৃণিত দুই আমেরিকান।

কিন্তু এই সমস্ত পরিবর্তনই যখন বোঝা গেল, তত দিনে খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধদেব ২০০১ এবং ২০০৬ সালে বাংলায় বামফ্রন্টের দু’টি বিজয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সিপিএম ব্র্যান্ডে বাম রাজনীতির দিন তখন শেষ। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে এর প্রথম সঙ্কেত পাওয়া গিয়েছিল। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সেই সত্য নিশ্চিত হয়ে দেখা দেয়।

বুদ্ধদেব স্রোতের অভিমুখকে ফেরাতে পারেননি। যে মানুষটিকে এক আলোকিত বঙ্গের অগ্রদূত বলে ভাবা হয়েছিল, তাঁর নেতৃত্বেই দীর্ঘ বামজমানার অবসান হল। তিনি থাকুন বা না থাকুন, বামেদের দিন ফুরিয়েছিল নিশ্চিত। সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা এবং নন্দীগ্রামে পেট্রো-কেমিক্যাল প্রকল্প নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবাদ তখন বাংলার রাজনীতির মঞ্চে নির্ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও ভবিষ্যদ্বাণীই ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের পক্ষে যায়নি। দেওয়ালের লিখন তখন নিদারুণ ভাবে স্পষ্ট— বুদ্ধদেব ও তাঁর দলের দিন ফুরিয়েছে।

(লেখক সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement