উলুবেড়িয়া স্টেশনে উপড়ে ফেলা হয়েছে বসার জায়গা। আটকে পড়েছে ট্রেন। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র
অনেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বন্ধুরা দিঘা যাব। শুক্রবার বেলা পৌনে তিনটেয় ছাড়ল কান্ডারি এক্সপ্রেস। বেলা সাড়ে তিনটে-পৌনে চারটে নাগাদ উলুবেড়িয়া পৌঁছল ট্রেন। তিনটে বগি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরোতে না বেরোতেই আচমকা ব্রেক কষে থেমে গেল ট্রেন।
ভাবলাম সিগন্যালের সমস্যা। কিন্তু মিনিট পনেরো পরেও ট্রেন না ছাড়ায় দরজা খুলে দেখি রেললাইনের উপর কাতারে কাতারে লোক। লাইনের উপরে সার-সার টায়ার জ্বলছে! লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক জনের কাছে চেঁচিয়ে কারণ জানতে চাইলাম। ওঁরা জানালেন, অবরোধ চলছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রতিবাদে।
তখনও বুঝতে পারিনি, কী বিপদ অপেক্ষা করছে! বন্ধুরাও বলল, একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘টিম লিডার’ সজল ঘোষকে বললাম, এখানেও কি শুরু হয়ে গেল?
আস্তে-আস্তে অন্ধকার নামছে। আচমকা পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হামসফর এক্সপ্রেসের গায়ে রেললাইনের পাথর পড়তে শুরু করল। ট্রেনে তো অনেকেই মহিলা-শিশুদের নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মুখ তখন ফ্যাকাসে।
হঠাৎ কামরার দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল জনা বিশেক লোক। ঠান্ডা গলায় ট্রেন খালি করার ‘নির্দেশ’ দিল তারা। এ-ও বলল, এর পরে কোনও বিপদ হলে কেউ দায় নেবে না। সেই নির্দেশ মেনেই ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নামলাম। অন্য কামরা থেকেও যাত্রীদের নামানো হচ্ছে। আশপাশে কোথাও পুলিশ-আরপিএফের দেখা মিলল না। কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কোনও মতে মালপত্র কাঁধে নিয়ে রেললাইন পেরিয়ে কয়েক জন বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসা করে একটি উড়ালপুলে উঠলাম।
অন্ধকারে হেঁটে উড়ালপুল পেরিয়ে জাতীয় সড়কের দিকে এগোতে থাকলাম। বন্ধুদের সঙ্গে ভাল করে কথাও বলতে পারছিলাম না। কারণ, রাস্তার পাশে যারা রয়েছে, তারা যেন সবসময় নজর রাখছে আমাদের। মোবাইল বের করে কথা বলতে গেলেও ধমক দিচ্ছিল তারা। কোনও মতে জাতীয় সড়কে উঠেও ফের ধাক্কা! সেখানেও অবরোধ।
ভাবছিলাম, অনেক হয়েছে দিঘা ঘোরা। এ বার কোনও মতে বাস পেয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারলেই হল! বিক্ষোভের মুখে ট্রেন যায়। করমণ্ডল এক্সপ্রেস ছাড়ে রাত ৮টা নাগাদ।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ বলেন, ‘‘বিক্ষোভকারীরা উলুবেড়িয়া স্টেশনে ঢুকে অফিসের ৮টি কম্পিউটার, নগদ ৪ লক্ষ টাকা এবং সমস্ত ছাপা টিকিট লুট করে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের একটি নতুন রেক ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। এর জেরে ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে।’’ অবরোধকারীদের কোনও নেতা না-থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি দাবি করেছেন জেলা (গ্রামীণ) পুলিশের এক কর্তা।
বিকেল থেকে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় ট্রেন অবরোধ হয়। বেলডাঙা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়। ভাঙচুর চালানো হয় স্টেশন মাস্টারের অফিসে। লাইনে বসে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। হামলায় রেল পুলিশের কর্মী জখম হন। ওই লাইনেও ট্রেন চলাচল থমকে যায়।