ছৌ নাচে মেতেছেন নিত্যানন্দ মান্ডি (ইনসেটে)। নিজস্ব চিত্র
লে দুগ্গা, সামলা!
বলে লাথি কষিয়ে হাঁক পাড়ল সুকুমার। সুকুমার মুর্মু— এ তল্লাটের ডাকসাইটে ফরোয়ার্ড। মাঠে ভিড় করা ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মদ্দোও চিল পাড়ছে— গো-ও-ও-ল!
গোলটা নিশ্চিতই হয়তো ছিল। কিন্তু ওই যে খানিক বাঁকা স্বরে ‘দুগ্গা’ হাঁকল সুকুমার, ওলটপালট হয়ে গেল নিত্যানন্দের অন্তর-বাহির। গোলার মতো ধেয়ে আসা বলটা জালে জড়ানোর আগে যে ধরতেই হবে! সবটুকু শক্তি জড়ো করে আকাশপানে ঝাঁপালেন নিত্যানন্দ। বল ধরা পড়ল বাহুডোরে।
আরও পড়ুন: সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ ও পুজোর ‘সন্ধিক্ষণে’ রাজ্য
আরও পড়ুন: ৭৫ শতাংশ আক্রান্তই বাড়িতে, বাড়ছে বিপদ
নিত্যানন্দ মান্ডি। সাকিন: বামুনডিহা গ্রাম। ব্লক: জামবনি। জেলা: ঝাড়গ্রাম। পেরিয়ে আসা তেইশটা বসন্তে নামের প্রতি সুবিচার করেনি জীবন। দুই পেরোতে না পেরোতেই দিনমজুর বাপ রাজেন মান্ডি চোখ বুজলেন। তিন বছরের ফারাকে ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে মা ফুলমণি তখন থইহারা। লোকের বাড়ি খেটে, মাঠে চষে ছেলেমেয়ের মুখে ভাত জোগাতেন। স্কুলেও পাঠিয়েছেন দু’জনকে— বারো ক্লাস পর্যন্ত।
‘‘কলেজে পড়া আর হল না। তত দিনে মাথায় জাঁকিয়ে বসেছে ফুটবল আর দুগ্গা’’— এক গাল হেসে বললেন বনতলে বেড়ে ওঠা যুবক।
দুর্গাই তাঁর ভোকাট্টা জীবন-ঘুড়ির নতুন মাঞ্জা।
খড়-মাটির মাতৃ-মূর্তি নয়, কাঁচা বয়সে প্রথম ঘোরটা লেগেছিল জ্যান্ত দুর্গাতেই। সাঁওতাল গ্রাম বামুনডিহায় দুর্গাপুজোর চল নেই। পুজো হয় পাশের গ্রাম টুলিবরে। তবে পালা-পার্বণে বামুনডিহায় উৎসব হত, আসত ছৌ নাচের দল।
নিত্যানন্দ তখন ছয় কি সাত। শিবরাত্রিতে ঢ্যারা পড়ল— এ বারের পালা মহিষাসুর বধ। লাল মাটির ধুলো মেরে জল ছিটিয়ে মঞ্চ তৈরি। ঢোল-ধামসায় বোল উঠল— দিদির দাং/দিদির দাং/দিদির দিদির দাং। সুর ধরল সানাই-শিঙে-চড়াচড়ি। আগমনিতেই উথাল-পাথাল কিশোর। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—
সিংহের পিঠে চেপে বিটির কী তেজ! মহিষের ভেকধারী অসুরটার টিকি ধরে ত্রিশূলের খোঁচায় ছাতি একেবারে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিলে! পরনে গোলাপ রঙা শাড়ি, গা ভরা গয়না, দশ হাতে অস্ত্রের ঝলকানি আর ওই পেখম মেলা জমকালো মুখোশ— রণরঙ্গিনী অবয়বই গেঁথে গেল মুগ্ধ কিশোরের মগজে। দিবারাত্র কানে বাজে— ‘করিব অসুর নিধন/করিব নতুন সৃজন’।
‘‘ওই বয়সেই ঠিক করে ফেলেছিলাম ছৌয়ের দলে ঢুকবই। দুর্গতিনাশিনী নিজে যেখানে জীবন্ত, সেখানেই তো মোক্ষ’’, বিশ্বাস নিত্যানন্দের। তবে তাঁদের গ্রাম ছৌয়ের আদত মাটি নয়। মা, দিদিকে ফেলে পুরুলিয়া গিয়ে শেখার জো-ও তখন ছিল না।
শেষে সুযোগ এল গ্রামেই। ২০১৬ সাল। নিত্যানন্দ উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন। ‘বামুনডিহা উৎনাও গাঁওতা’র উঠতি গোলকিপার হিসেবে হাত পাকাচ্ছেন। গ্রামেরই যুবক মিঠুন মাহাতো ধুয়ো তুললেন, ‘‘বামুনডিহায় একটা ছৌয়ের দল হবেক।’’ চাঁদা তোলা শুরু হল, ছেলেপুলের খোঁজ পড়ল। ছৌয়ের ধারাই হল সব ভূমিকায় শুধু ছেলেরাই নাচ-গান-অভিনয় করবে। প্রথা ভাঙার কথাই নেই। তাই নিত্যানন্দ জুটে গেলেন দলে।
মিঠুনের বাবাদের ছৌয়ের দল ছিল এক সময়। আটঘাট তাঁর সব জানা। ‘‘ফিমেল পার্টের জন্য অডিশন হয়েছিল। চার-চারটে ছেলে পরীক্ষায় বসল। ডায়লগ বলা, নাচ, গান— দেখা হল সবই। আমাদের নিত্যানন্দই ছিল সবার সেরা’’, গর্ব ভরেই বললেন মিঠুন।
নিত্যানন্দের আঁধার ঘরে সে দিন কূল ছাপানো জোছনা। আশৈশব যে স্বপনলেখায় মুগ্ধ তাঁর নয়ন, তাই আজ সত্যি!
পুরুলিয়া থেকে ছৌয়ের ওস্তাদ এল। শুরু হল তালিম। একতাল-ঝাঁপতাল-মেলতালের ওঠা-পড়া, ঝাড়ন-কম্পন-সঞ্চারণ-সঞ্চালনের খুঁটিনাটি— শেখায় কোনও ফাঁক রাখেননি নিত্যানন্দ। ওস্তাদেরও ভারী মনে ধরল তাঁকে। তারপর চার বচ্ছর ‘দুর্গারূপেণ সংস্থিতা’। এগরা, কাঁথি, বেলদা, ঘাটাল— কম শো করেননি। পুরুলিয়ায় গিয়েও মন জিতেছেন।
ফুটবল নাকি ছৌ?
‘‘দু’টোই।’’
কিন্তু পাঁচ ফুট ছয় ছুঁই ছুঁই টগবগে যে ছেলেটার রিংটোনে টাটকা বলিউড, হোয়াটস্অ্যাপ ডিপিতে স্বপ্নের বাহারি বাইক, তার সঙ্গে তো ফুটবলটাই যায়?
‘‘ভালবাসার আবার গৎ থাকে নাকি! ছৌ আমার কচিবেলার প্রেম। হাঁড়িয়া-মহুলের থেকেও এর নেশা কড়া’’—আবেগে গলা বুজে আসে নিত্যানন্দের।
সেই নেশার টানে হার মানে খিদেও। অভাবের ঘরে একমাত্র পুরুষ। তাড়নাতেই এসেছিলেন হাওড়ার সাঁকরাইলে, কারখানার কাজে। ভিন্ মাটির জলহাওয়া সয়নি। বাঁধা রোজগার ছেড়েই পালিয়েছেন গ্রামে।
তবে ফুটবল বা ছৌ, পয়সা নেই কোনওটাতেই। ছৌয়ের একটা শোয়ে পাঁচশো টাকা। আর রাত-দিনের টুর্নামেন্টে সব ম্যাচ খেলার সুযোগ হলে সাকুল্যে দু’শো। আর এখন তো করোনায় সব ওলটপালট। বামুনডিহার দুগ্গা তাই দিনমজুরিতে যান। অস্ত্র ধরা হাতে কখনও কোদাল, তো কখনও কীটনাশকের স্প্রে-বোতল।
মেয়ে রূপালির বিয়ের পরে ফুলমণির এখন মায়ে-পোয়ে সংসার। ছেলের ভাললাগায় বাধা হননি কখনও। তবু গলায় খেলে আক্ষেপ, ‘‘একটা থিতু রোজগার তো লাগে!’’
বোঝেন নিত্যানন্দও। কিন্তু লড়াইয়ের মাটি ছাড়তে মন সায় দেয় না। কচিবেলার প্রেম বাঁচাতে কম তো লড়ছেন না। ছেলে হয়ে মেয়ে সাজেন বলে খোঁটাও শোনেন। নিত্যানন্দ বলেন, ‘‘লোকে বোঝেই না এই ভালবাসার পিছনে একটা সাবেক শিল্প বাঁচানোর লড়াইও আছে। তবে বাঁকা কথা গায়ে মাখি না। ওস্তাদ শিখিয়েছেন, শিব আর শক্তি সৃষ্টিতে দুই-ই সমান। যিনি গড়েছেন, তিনি ছেলেমেয়ে ফারাক করেন না, তো আমরা কে!’’
কিন্তু ছৌয়ের দলে মেয়েদের আসতে মানা ছিল বলেই কিনা মেয়েদের অভিনয় ছেলেরা করে! এখনও তো মেয়েদের দলে আনার চেষ্টা তেমন সাড়া ফেলেনি!
‘‘আমি তো চাই দলে মেয়েরা আসুক। আর ছেলেদের পার্ট করুক। তবেই তো প্রথা ভাঙবে, প্রথা গড়বেও,’’— দুর্গা-কণ্ঠে সহসা রণভেরী।
মাটির দাওয়ায় মহড়ার আয়োজন সারা। ৪০ ওয়াটের বাল্বেই ধুয়ে যাচ্ছে আঁধার। জরি বোনা গোলাপি শাড়ি, রঙিন মালা, দশপ্রহরণে সাজছেন দুর্গা। বোল উঠছে ধামসায়, হারমোনিতে সুর— ‘করিব অসুর নিধন/করিব নতুন সৃজন।’