বেতনী নদীতে এখনও খোঁজ নেই অনেকের, তল্লাশিতে গা-ছাড়া প্রশাসন

সন্দেশখালির বেতনী নদীতে যাত্রী-বোঝাই নৌকো ঢুবে যাওয়ার পরে কেটে গিয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। এখনও নিখোঁজ যাত্রী বা ওই নৌকোর হদিস মিলল না। উদ্ধারের কাজে প্রথম দিকে প্রশাসনের খানিকটা তত্‌পরতা চোখে পড়লেও রবিবার তা বিশেষ দেখা যায়নি। সে জন্য ক্ষোভ আছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে।

Advertisement

নির্মল বসু

সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০৭
Share:

নৌকো নামিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছেন স্থানীয় মানুষ।—নিজস্ব চিত্র।

সন্দেশখালির বেতনী নদীতে যাত্রী-বোঝাই নৌকো ঢুবে যাওয়ার পরে কেটে গিয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। এখনও নিখোঁজ যাত্রী বা ওই নৌকোর হদিস মিলল না। উদ্ধারের কাজে প্রথম দিকে প্রশাসনের খানিকটা তত্‌পরতা চোখে পড়লেও রবিবার তা বিশেষ দেখা যায়নি। সে জন্য ক্ষোভ আছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে।

Advertisement

শনিবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আলো জেলে বসিরহাটের সাংসদ ইদ্রিশ আলি এবং এসডিপিও অভিজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্যান্য আধিকারিকেরা তল্লাশি অভিযান দেখভাল করেন। তাঁরা চলে যাওয়ার পরে রবিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রশাসন কিম্বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিশেষ কাউকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। সরকারি ভাবে তল্লাশিও তেমন চোখে পড়েনি বলে জানালেন স্থানীয় মানুষ। তাঁদের দাবি, দু’এক বার প্রশাসনের লঞ্চ এবং ডুবুরিদের এলাকায় ঘুরে যেতে দেখা গেলেও তল্লাশিতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি কেউ। গ্রামবাসীরা অনেকে নিজেরাই চাঁদা তুলে নৌকো ভাড়া করে নদীতে খোঁজাখুঁজি চালিয়েছেন।

শনিবার বেলা ১২টা নাগাদ ন্যাজাট থেকে একটি যন্ত্রচালিত ভুটভুটি কাঠখালি গ্রামের দিকে রওনা দেয়। নৌকার ছইয়ের উপরে প্রচুর ইমারতি সরঞ্জাম রাখা ছিল। নীচে এবং উপরে প্রায় ৪০-৫০ জন যাত্রী ছিলেন। নৌকাটি কালীনগর হয়ে বেড়মজুরের দিকে যাওয়ার সময়ে মসজিদবাড়ি দক্ষিণপাড়ার কাছে উল্টে যায়। একটি বড় নৌকো সেই দৃশ্য দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে। ভুটভুটিতে থাকা একাধিক পুরুষ যাত্রী লাফিয়ে ওঠেন সেখানে, কেউ কেউ সাঁতরেও পাড়ে ওঠেন। কিন্তু মহিলা-বৃদ্ধ এবং শিশুরা তলিয়ে যেতে থাকেন।

Advertisement

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, স্রোত বেশি থাকায় কলকাতা এবং বিএসএফের পক্ষ থেকে আসা ডুবুরিরা ফিরে গিয়েছেন। স্থানীয় ডুবুরিদের এখন কাজে লাগানো হচ্ছে। উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় জোয়ার-ভাটায় ঠিক ভাবে তল্লাশি চালানো যাচ্ছে না। এই খবর পেয়ে রবিবার সাংসদ ইদ্রিশ আলি কথা বলেন জেলা প্রশাসনের সঙ্গে। সাংসদ বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ তলিয়ে যাওয়া নৌকা এবং নিখোঁজ যাত্রীদের খোঁজ বন্ধ করা চলবে না। আমরা গভীর রাত পর্যন্ত তল্লাশি অভিযানে সামিল ছিলাম। এখন শুনছি তল্লাশি ঠিক মতো হচ্ছে না। তা কখনই হতে পারে না। জেলাশাসককে বলা হয়েছে, নৌকো এবং নিখোঁজ মানুষের সন্ধান না মেলা পর্যন্ত কোনও অবস্থাতেই তল্লাশি যেন বন্ধ না থাকে।”

বিকালে ঘটনাস্থলে যান বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আমরা সব রকম ভাবে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছি। তবে ডুবুরিতের তো আর জোর করে জলে নামানো যায় না। তা ছাড়া, স্রোতের টানে নৌকোটি যে কোথায় চলে গিয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে না।” বসিরহাটের মহকুমাশাসক শেখর সেন বলেন, “স্রোত বেশি থাকায় ডুবুরি নামিয়েও নিখোঁজ মানুষ কিংবা নৌকার কোনও হদিশ মেলেনি। তবে তল্লাশি অভিযান জারি রাখা হয়েছে।” এ দিনও নিখোঁজ গ্রামবাসীদের পরিবার-পরিজনকে নদীর ধারে বসে থাকতে দেখা যায়। ভুটভুটিতে ছিলেন দ্বারিকজঙ্গল গ্রামের বাসিন্দা বিশ্বজিত্‌ দাস ও তাঁর স্ত্রী অলোকা। দু’মাসের শিশুকে তাঁরা ন্যাজাটে নিয়ে এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। নৌকো উল্টোতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নদীপাড়ের বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী অনিল দাস বলেন, “বাচ্চাকে দু’হাতে উচুঁ করে কোনও মতে পাড়ের দিকে আসছিলেন ওই দম্পত্তি। উল্টে যাওয়া নৌকোর যাত্রীদের বাঁচাতে আসা বড় নৌকোর ধাক্কায় বিশ্বজিত্‌বাবুর হাত থেকে শিশুটি জলে পড়ে তলিয়ে যায়।” বেতনীর দিকে তাকিয়ে নদী পাড়ে বসে ছিলেন ন্যাজাটের বাসিন্দা অনিতা সর্দার। বললেন, “শাশুড়ি সাবিত্রী সর্দারকে তুলে দিয়েছিলাম ভুটভুটিতে। কাল থেকে নদী পাড়ে বসে আছি, শাশুড়ির কোনও খোঁজ পাচ্ছি না।” রোদের হাত থেকে বাঁচতে মায়ের সঙ্গে নৌকার ছইয়ের নীচে বসেছিল কাঠখালি গ্রামের সাত বছরের রিয়া দাস। নৌকো উল্টে গেলে একটা মাদুরের গাঁট ধরে কোনও মতে ভেসে প্রাণে বেঁচেছে। কিন্তু তার মায়ের কোন খোঁজ নেই। নদীপাড়ের বাসিন্দা সঙ্গীতা দাস বলেন, “আমরা মেয়েটাকে যখন জল থেকে তুলি, তখন‌ ও মায়ের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়েছে। খবর পেয়ে ওর দাদু এলে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে রিয়াকে।”

নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা ঠিক কত, তা নিয়েও সঠিক তথ্য নেই প্রশাসনে কাছে। নৌকোর যাত্রী ছিলেন ধুলিয়া ঝুপখালি গ্রামের রীতা সর্দার। ছেলে পবিত্র, মেয়ে শ্রেয়া এবং শাশুড়ি নীরবালাকে নিয়ে ন্যাজাট থেকে ফিরছিলেন। রীতাদেবী বলেন, “ছইয়ের মাথায় সিমেন্টের বস্তার উপরে বসেছিলাম। নৌকো এক দিকে হেলতেই বস্তাগুলো জলে পড়তে শুরু করল। আমরাও পড়ে গেলাম। কোনও মতে মালপত্র জাপটে ধরে ভেসে ছিলাম। গ্রামের লোক এসে উদ্ধার করে।”

এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেল, কিছু ক্ষণ আগে এক জন ডুবুরি সাইকেল হাওয়া দেওয়া মেসিনের সাহায্য নিয়ে জলে নামলেও একটু পরেই উঠে পড়েন। কাঠখালি গ্রামের শিশু উন্নয়ন সঙ্ঘের সদস্যেরা চাঁদা তুলে ১২০০ টাকা দিয়ে নৌকো ভাড়া করে নিখোঁজ যাত্রীদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছিলেন।

ক্লাবের সম্পাদক রাজবল্লব সর্দার এবং সন্দেশখালি পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান মহেশ্বর সর্দার বলেন, “বেড়মজুরের সোমবালক সর্দার-সহ আমাদের এলাকা থেকে ৬ জনের কোনও খোঁজ মিলছে না। তাই উদ্ধারের কাজে প্রশাসনকে সাহায্য করতে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে দেখছি প্রশাসনের ভূমিকা স্রেফ দর্শকের। নদীতে স্রোতের কথা বলে ডুবুরিরা কেউ জলে নামতে চাইছেন না। আমাদের ছেলেরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। আর দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে প্রশাসনের লঞ্চ। পুলিশের পক্ষে থেকে বিকেলের দিকে সামান্য তল্লাশি শুরু হয়।” নদী পাড়ে জেলেপাড়ার বাসিন্দা নুর ইসলাম গাজি, শঙ্কর করণ, সুকুমার সরকার, রবিউল হাসান মণ্ডল-সহ কয়েক জন দুর্ঘটনার পর থেকে নিজেদের উদ্যোগে নৌকো নিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছেন। তাঁদের কথায়, “আগেও কয়েকটি ভুটভুটি উদ্ধার করেছি। কী ভাবে জলে ডোবা নৌকো উদ্ধার করতে হয়, তা আমাদের জানা। কলকাতা থেকে আসা ডুবুরিরা দু’একবার জলে নামলেও আমরা কিন্তু ডুবন্ত নৌকোর সিমেন্ট, চালের বস্তা উদ্ধার করেছি। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষে ভুটভুটি চালানোর সামান্য তেলও কেউ দিচ্ছে না।” নির্মল দাস, সুকুল নবি গাজি, রাজু সর্দাররা বলেন, “ইতিমধ্যে যতযুকু জানা গিয়েছে, তাতে বেড়মজুর গ্রামের ৭ জন, দ্বারিকজঙ্গল গ্রামের ৩ জন এবং ন্যাজাটের ১ জনের খোঁজ নেই। আশপাশের গ্রামের আরও মানুষ থাকতে পারে। তবে এত ক্ষণে নদীতে দু’টো জোয়ার-ভাটা খেলে গিয়েছে। ফলে তলিয়ে যাওয়া নৌকোয় পলি জমতে শুরু করেছে। আর দু’একটা জোয়ার-ভাটা খেললে নৌকো খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। তল্লাশিতে যত দেরি হবে, ততই নৌকো কিংবা নিখোঁজদের উদ্ধারের সম্ভাবনা কমবে।”

তবে এতে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও কিন্তু ভুটভুটিতে অতিরিক্ত মাল এবং প্রচুর পরিমাণে যাত্রী তোলার প্রবণতা কিন্তু কমেনি। রবিবারও ন্যাজাট ফেরিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, উপচে পড়া মালপত্রের সঙ্গে যাত্রীও চলেছেন ভুটভুটিতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement