ফাইল চিত্র।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা ভেঙে তৈরি হচ্ছে নতুন জেলা সুন্দরবন। সোমবারই রাজ্য জুড়ে একাধিক নতুন জেলার পাশাপাশি সুন্দরবন জেলা তৈরির কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছ’মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা। আলাদা জেলার খবরে খুশি সুন্দরবনের মানুষ। কিন্তু জেলার পরিধি কী হবে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা।
উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা সুন্দরবন হিসেবে পরিচিত। পুরোটাই নতুন জেলার অন্তর্ভুক্ত হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
অনেকের মতে, হিঙ্গলগঞ্জ থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এই এলাকাকে নিয়ে আলাদা জেলা হলে প্রশাসনিক কাজে সুবিধার থেকে অসুবিধাই হবে বেশি। কারণ, যেখানেই জেলা সদর হোক না কেন, প্রান্তিক এলাকা থেকে সেখানে পৌঁছতে মানুষকে সমস্যায় পড়তে হবে। শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগনার অন্তর্গত সুন্দরবনকে নিয়ে আলাদা জেলা তৈরি হলেও এই সমস্যা থেকে যাবে বলেই মত অনেকের। সে ক্ষেত্রে ক্যানিংয়ের মানুষকে কাকদ্বীপে যেতে বা কাকদ্বীপের মানুষকে ক্যানিংয়ে আসতে সমস্যায় পড়তে হবে।
আবার সুন্দরবনের কোনও অংশকে বাদ দিয়ে সুন্দরবন জেলা হলে সুন্দরবনবাসীর একাংশ বঞ্চিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা। এ ক্ষেত্রে অনেকেই বর্তমান পুলিশ জেলা ভাগের প্রসঙ্গ তুলেছেন। প্রশাসনিক কাজে সুবিধার জন্য কয়েক বছর আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনাকে তিনটি পুলিশ জেলায় ভাঙা হয়েছিল— বারুইপুর, ডায়মন্ড হারবার ও সুন্দরবন। কাকদ্বীপ, সাগর, নামখানা, পাথরপ্রতিমার বিভিন্ন থানা নিয়ে সুন্দরবন পুলিশ জেলা তৈরি হয়। গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি-সহ সুন্দরবনের একটা বড় অংশ পড়ে বারুইপুর পুলিশ জেলার মধ্যে।
অনেকেই মনে করেন গোসাবা, কুলতলি-সহ আশেপাশের এলাকা সুন্দরবনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। পর্যটকদের কাছেও সুন্দরবনের পরিচিতি মূলত এই জায়গাগুলিকে ঘিরেই। অথচ, এগুলিই সুন্দরবন পুলিশ জেলার বাইরে রাখা হয়।
প্রশাসনিক জেলার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। সে ক্ষেত্রে সুন্দরবনের অনেকটাই সুন্দরবন জেলার বাইরে থেকে যাবে। সুন্দরবন জেলায় পা না দিয়েও সুন্দরবন ঘুরে যেতে পারবেন দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকেরা। প্রকৃত সুন্দরবনের বহু মানুষই নিজেদের সুন্দরবন জেলার বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না।
ফলে সমস্যা দু’দিকেই। সমস্যা আরও রয়েছে। জেলা ভাগ হয়ে গেলে জলে-জঙ্গলে মাছ বা কাঁকড়া ধরার ক্ষেত্রে মৎস্যজীবীদের বিধিনিষেধের মুখে পড়তে হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের জয়নগর শাখার সম্পাদক মিঠুন মণ্ডল বলেন, “গরিব মৎস্যজীবীরা জঙ্গলে ঘুরে মাছ-কাঁকড়া ধরেন। জেলা ভাগের ফলে হয় তো তাঁদের নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়তে হবে। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় স্বাধীন ভাবে যাওয়া আসা করতে পারবেন না। এদিকটা প্রশাসনের নজর দেওয়া উচিত।”
এই প্রসঙ্গে অরণ্য জেলার দাবি তুলেছেন কেউ কেউ। দীর্ঘদিন সুন্দরবন এলাকায় নানা কাজে যুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী বলেন, “শুধু সুন্দরবনের জঙ্গল নিয়ে একটা জেলা হোক না। সেখানে গাছ-গাছালি, বন্যপ্রাণীদের দেখাশোনার জন্য জেলা প্রশাসন তৈরি হোক। মানুষের জেলাটা আলাদা থাক।” সুন্দরবন গবেষক উজ্জ্বল সর্দারের কথায়, “সুন্দরবনের জঙ্গল, পশু-পাখিরা ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। আলাদা অরণ্য-জেলা করে এদের রক্ষা করা যেতে পারে।”
শেষ পর্যন্ত ঠিক কোন এলাকাকে নিয়ে সুন্দরবন জেলা তৈরি হয়, সে দিকে তাকিয়ে আছেন অনেকেই।