তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল। প্রতীকী চিত্র।
এক দিকে, শাসক তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল। অন্য দিকে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ— এই দুই অস্ত্রকে সামনে রেখে বিরোধীরা ঘর গোছানোর কাজ শুরু করেছে কাকদ্বীপে। ব্লকে ১১টি পঞ্চায়েত। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের জেরে অনেকে বিজেপিতে যোগ দেন বলে দলীয় সূত্রে দাবি। সে বার ১১টি পঞ্চায়েতের ২১৭টি আসনের মধ্যে ৬টিতে জিতেছিল বিজেপি। পঞ্চায়েত সমিতির ৩৩টি আসনের মধ্যে একটি পায় তারা। সিপিএম অবশ্য পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের কোনও আসনেই জয়লাভ করতে পারেনি। সমস্ত পঞ্চায়েতেই জেতে তৃণমূল। জেলা পরিষদের ৩টি আসনও তৃণমূলের দখলে ছিল।
গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে তৃণমূলের অন্দরে ফের কোন্দল শুরু হয় বলে দলীয় সূত্রে খবর। তৃণমূলের নতুন নেতাদের হাতে সংগঠনের দায়িত্ব আসে। বিভিন্ন কারণে পুরনো নেতাদের সঙ্গে নতুনদের বিবাদ বাধতে থাকে। জেলা নেতৃত্ব বার বার সকলকে এক সঙ্গে চলার বার্তা দিলেও খুব একটা লাভ হয়নি।
প্রতাপাদিত্যনগর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান দেবব্রত মাইতি বলেন, ‘‘ভাল কাজ করার জন্য আমাদের পঞ্চায়েত দু’বার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, একবার রাজ্য সরকারের পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু এখন আমাকে পঞ্চায়েতে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। রাস্তাঘাটে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দল ও প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি।’’ এ বিষয়ে তৃণমূলের সুন্দরবন সাংগঠনিক জেলার যুব সভাপতি বাপি হালদার বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
বিভিন্ন পঞ্চায়েতে এই ধরনের পরিস্থিতির সুযোগে বিরোধীরা মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে জানাচ্ছে ওয়াকিবহাল মহল। গত পঞ্চায়েতে মধুসূদনপুর, সূর্যনগর এবং রামগোপালপুর পঞ্চায়েতে বিরোধীরা প্রার্থীই দিতে পারেননি। পয়লা মে সেই মধুসূদনপুর অঞ্চলেই প্রায় ১৩ বছর পরে সিপিএম পতাকা উত্তোলন করে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে সেই পতাকা খুলে ফেলারও অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে দুই দলের মধ্যে হাতাহাতি হয়। কাকদ্বীপ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি বিজয়কৃষ্ণ দাস অবশ্য বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীরা তেমন কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না।’’
শাসক দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। নিকাশি, বাঁধ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে এলাকায়। আমপান, ইয়াসে ক্ষতিপূরণ বিলি নিয়ে নানা অভিযোগে বহু ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়েছিল। অনেক গরিব পরিবার ক্ষতিপূরণ না পেলেও অনেক পাকা বাড়ির মালিক টাকা পেয়েছেন, একই পরিবারের একাধিক সদস্য টাকা পেয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এঁদের সকলেই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে দাবি বিরোধীদের। বিষয়টি নিয়ে সে সময়ে সরব হয় বিজেপি-সিপিএম। আবাস যোজনার টাকা নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তৃণমূলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে ম্যানগ্রোভ কেটে মাছের ভেড়ি তৈরি করার অভিযোগ, পঞ্চায়েতের কাজে কাটমানির নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এলাকার বিধায়কের ঘনিষ্ঠ তথা তৃণমূলের সুন্দরবন সাংগঠনিক জেলার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি দেবাশিস দাসের (দেবা) বিরুদ্ধে কাকদ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় চাকরির দেওয়ার নাম করে লক্ষ লক্ষ প্রতারণার পোস্টার পড়ে।
অন্য দিকে, কাকদ্বীপ সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগে লক্ষ লক্ষ টাকা নিচ্ছেন নেতারা, এমন অভিযোগও উঠেছে। কোনও কোনও নেতা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের এনে মোটা টাকার বিনিময়ে ভোটার কার্ড দিচ্ছেন বলে অভিযোগ। শাসক দলের নেতারা অভিযোগ না মানলেও আইএসএফের মতো বিরোধী দলের উত্থানেই তা কিছুটা হলেও স্পষ্ট বলে দাবি অনেকের।
আগে কাকদ্বীপ এলাকায় আইএসএফের কোনও সংগঠন ছিল না। ২০২১ সালে বিশালাক্ষীপুর পুনাশাহ মস্তানিয়া হাই মাদ্রাসায় পরিচালন সমিতির ভোটে ছ’টি আসনে আইএসএফ পেয়েছিল পাঁচটি, তৃণমূল পায় একটি। এরপর থেকেই শক্তি বাড়াতে থাকে আইএসএফ। কিছু দিন আগে নেতাজি ও রবীন্দ্র অঞ্চলে আইএসএফ সভায় কয়েক হাজার লোক হয়েছিল। দলের নেতা মহম্মদ মনিরুল মোল্লা বলেন, ‘‘ধীরে ধীরে সংগঠন তৈরি হচ্ছে। মিটিং-মিছিল চলছে। ১১টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৮টিতে প্রার্থী দেব।’’
মাটি ছাড়তে নারাজ অন্য বিরোধীরাও। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রাম দাস বলেন, ‘‘তৃণমূল থেকে অনেকে দলে ফিরছেন। মিটিং-মিছিল শুরু হয়ে হয়েছে।’’ বিজেপি নেতা গোপালকৃষ্ণ দাস বলেন, ‘‘গত পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি। ফলে বিনা লড়াইয়ে অনেক আসনে জিতেছিল। এ বার তৃণমূলের দুর্নীতি, গোষ্ঠীকোন্দলের বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়াবেন।’’ কাকদ্বীপ ব্লক তৃণমূল সভাপতি বিজয়কৃষ্ণ দাস অবশ্য বলেন, ‘‘আমাদের দ্বন্দ্ব, কোন্দল নেই। সংগঠনকে মজবুত করার চেষ্টা করছি।’’