নির্বাচন ঘিরে আবারও অশান্ত বাসন্তি। — ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোট যতই এগিয়ে আসছে ততই নতুন করে উত্তপ্ত হচ্ছে বাসন্তী। প্রায়ই বোমা, গুলির লড়াইয়ে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। এলাকা কার্যত বারুদের স্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে— মনে করেন স্থানীয় অনেকেই।
এক সময়ে বামেদের দুই শরিক আরএসপি ও সিপিএমের মধ্যে এখানে বিবাদ লেগে থাকত। বোমা-গুলির লড়াইয়ে বার বার উত্তপ্ত হয়েছে বাসন্তী। বর্তমানে সেই বিবাদ ছড়িয়েছে তৃণমূলের যুব ও মূল (স্থানীয় ভাষায়, মাদার) দলের মধ্যে।
মূলত পঞ্চায়েতগুলির উপরে দখল ঘিরেই বরাবরের উত্তেজনার পরিবেশ এখানে। পঞ্চায়েতের দখল থাকলে টাকা-পয়সার উপরে নিয়ন্ত্রণ থাকবে। আর সে জন্য দরকার পেশিশক্তি।
রাজ্যে তৃণমূল ২০১১ সালে ক্ষমতায় এলেও বাসন্তীতে সে বার বিধানসভা ভোটে জিততে পারেনি। নেপথ্যে, সেই গোষ্ঠীকোন্দলই ছিল কারণ। এমনটাই মনে করেন দলের একাংশ। পরে একের পর এক বিরোধী দলের থেকে অনেকে যোগ দিতে থাকেন তৃণমূলে। ২০১৬ সালে এই কেন্দ্রে জয়ী হন গোবিন্দচন্দ্র নস্কর (বর্তমানে প্রয়াত)।
কিন্তু ভোট মিটতেই ফের তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ প্রকট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কাঁঠালবেড়িয়া, ফুলমালঞ্চ, চরাবিদ্যা পঞ্চায়েত এলাকায় কোন্দল সব থেকে বেশি মাথাচাড়া দেয়। তবে সময় যত গড়িয়েছে, ততই দলের কোন্দল আশপাশের পঞ্চায়েতগুলিতেও ছড়িয়েছে।
২০১৬ সালের পর থেকে বার বার তৃণমূলের গোষ্ঠীসংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়েছে বাসন্তীর মাটি। এই ক’বছরে প্রায় ২৫ জন রাজনৈতিক সংঘর্ষের বলি হয়েছেন এখানে। এ ছাড়া গুলি-বোমা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা তো অসংখ্য। দলের নেতারা বহু বৈঠক করেও সমাধান করতে পারেননি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দু’পক্ষকে সংযত হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। তাতেও সমস্যা মেটেনি।
বাসন্তীর বর্তমান বিধায়ক শ্যামল মণ্ডলও এলাকায় শান্তি ফেরাতে বার বার দলের কর্মীদের বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। যুব তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ অবশ্য তাঁর উপরে সন্তুষ্ট নন। বিধায়ক এলাকার যুব তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে মিটিং,-মিছিল, দলীয় কর্মসূচি পালন করছেন বলে অভিযোগ তাঁদের। এই অভিযোগ জানাতে কয়েক দিন আগে বাসন্তীতে তৃণমূলের জনসভায় যোগ দিতে আসা রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখান এই যুব তৃণমূল কর্মীরা।
সেই ঘটনার পর থেকে ফের নতুন করে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে। সেই জনসভার পাল্টা হিসাবে রবিবার কাঁঠালবেড়িয়ায় সভা করেছে যুব তৃণমূল।
শ্যামল বলেন, “দলের মধ্যে কোন্দল নেই। নিজেদের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে। সে বিষয়ে দলের উচ্চ নেতৃত্বকে জানানো হয়েছে। যাতে দ্রুত সেই সমস্যা মিটে যায়, সেই উদ্যোগ করা হচ্ছে। আর বাসন্তীতে যারা অশান্তি ছড়াচ্ছে তাদেরকে কখনওই দল সমর্থন করে না। এ বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”
যুব তৃণমূলের সুন্দরবন সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বাপি হালদার বলেন, ‘‘দল বড় হলে এ রকম ছোটখাট সমস্যা হয়। আমাদের মধ্যে কোনও গোষ্ঠীকোন্দল নেই। যেটুকু ভুল বোঝাবুঝি আছে, সেটাও দ্রুত মিটে যাবে।’’
কিন্তু কিসের টানে এই দলাদলি?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কংগ্রেসের এক নেতা বলেন, “পঞ্চায়েতের দখল রাখতে পারলে অনেকগুলো সুবিধা আছে। পঞ্চায়েতে নানা খাতে অগাধ টাকা আসে। সেই টাকা নয়ছয়ের সুযোগ থাকে। তা ছাড়া, পঞ্চায়েত নিজেদের দখলে থাকলে এলাকার জমি, মাছের ভেড়ি সবই দখলে থাকবে। সেখান থেকেও আয়ের সুযোগ আছে। সে কারণেই এই বিবাদ।” বামেদের আমলেও এ কারণেই বিবাদ বাধত বলে তাঁর মত। এলাকার সাধারণ মানুষও কার্যত এই কথাই বলছেন। পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে আসায় তাঁরা আরও বড় গোলমালের আশঙ্কা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা নবিরালি সর্দার, রশিদ গায়েনদের মতে, সাধারণ মানুষের এখানে কোনও নিরাপত্তা নেই। যখন তখন এলাকায় অশান্তি শুরু হয়। পঞ্চায়েত ভোট আসছে। গোলমাল বাড়বেই। কবে যে একটু শান্তি আসবে!
কোন্দল মিটে যাবে বলে মনে করেন তৃণমূলের সুন্দরবন সাংগঠনিক জেলার সভাপতি জয়দেব হালদার। তাঁর কথা, ‘‘বাসন্তীতে দলের এই সমস্যা মিটে গিয়েছিল। তবে নতুন করে আবার কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেটাও দ্রুত মিটে যাবে। দ্রুত এ বিষয়ে দলীয় নেতৃত্ব বাসন্তীর সব পক্ষকে নিয়ে বসে সমস্যার সমাধান করবেন। তবে যারা এলাকায় অশান্তি ছড়াচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পুলিশ-প্রশাসনকে বলা হয়েছে।”