হাতেকলমে: চলছে তালিম, ছবি: নবেন্দু ঘোষ।
হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার নানা উপকরণ সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবনের কাঁটামারি, গোসাবা কিংবা ছোটমোল্লাখালির মতো প্রত্যন্ত দ্বীপে লঞ্চে চেপে পৌঁছে যাচ্ছেন সায়েন্স কমিউনিকেটর্স ফোরামের সদস্যেরা। উদ্দেশ্য, ২০টি দূরবর্তী এলাকার ৫০টির বেশি স্কুলের পড়ুয়াদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার আগ্রহ তৈরি করা।
যোগাযোগের প্রতিকূলতার কারণে কলকাতা বা শহরতলির থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অধিকাংশই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত স্কুলে বেশি দিন পড়াতে চান না বলে অভিযোগ। কিছু দিন যেতে না যেতেই বদলি নিয়ে তাঁরা চলে আসেন বাড়ির কাছাকাছি।
ফলে উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাবে সুন্দরবনের বেশিরভাগ স্কুলেই মার খাচ্ছে বিজ্ঞান-ভূগোল-গণিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাঠ। ঊপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখা চালু করা যাচ্ছে না বহু স্কুলে। গৃহশিক্ষক রাখার খরচের আশঙ্কাতেও পিছিয়ে যাচ্ছে অনেক পড়ুয়া।
এক সঙ্গে ১৫-২০ জন থাকতে পারেন, এমন দু’টি ভেসেলে বিজ্ঞান শিক্ষার বিভিন্ন উপকরণ সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন ফোরামের সদস্য শিক্ষকেরা। জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের কিছুটা অনুকূল আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে তাঁরা পৌঁছে যাচ্ছেন সন্দেশখালি, কুলতলি, হিঙ্গলগঞ্জ, পাথরপ্রতিমার বিভিন্ন ঘাটে। সেখানে কাছাকাছি একাধিক স্কুলের পড়ুয়াদের কোনও একটি এনে এক লপ্তে চার দিনের শিবির অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রত্যেক ভেসেলে ছোট আকারের জেনারেটর, প্রোজেক্টর, টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ ছাড়াও জল এবং মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকছে। ঘরোয়া বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে হাতে কলমে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখানোর ব্যবস্থাও থাকছে। জীব বিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান, ভূগোল এবং অঙ্কের বিভিন্ন বিযয় পড়ুয়াদের বিভিন্ন মডেল ব্যবহার করে বোঝানো হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের বিষয় ছাড়াও পরিবেশ এবং বাস্ততন্ত্রের ধারণাও পাচ্ছে পড়ুয়ারা। সুন্দরবনের পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্ত ধরে থাকছে দু’টি ভেসেল।
কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি দফতর এবং রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দফতর স্কুলগুলিতে শিবির আয়োজনে সাহায্য করেছে। স্কুলে শিবির করার আগে গত নভেম্বর মাসে এলাকার ৫০টি স্কুলের প্রায় ২০০ জন শিক্ষককে নিয়ে কর্মশালাও করেছে ফোরাম। পরে প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে মোবাইল লার্নিং কিট। উদ্দেশ্য, চার দিনের শিবির শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যাতে বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী পড়ুয়াদের উৎসাহে যাতে ভাটা না পড়ে।
ফোরামের অন্যতম এক সংগঠক বলেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি তাদের সমস্যা কাছ থেকে বুঝতে চাওয়া আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। তাই পুরো প্রক্রিয়াটিই যোগদানমূলক।’’
হিঙ্গলগঞ্জের কণকনগর এসডি ইন্সটিটিউশনের প্রধান শিক্ষক পুলক রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী এবং প্রয়োগমূলক দিকগুলি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহী করে তোলা যাচ্ছে, এটাই বড় কথা।’’
ভান্ডারখালির বাসিন্দা অনির্বাণ দাস বা অন্বেষা মিশ্রের মতো হিঙ্গলগঞ্জের ঝর্না খাতুন কিংবা অসীমা বাগদিদের কৃষি এবং মৎস্যজীবী পরিবার থেকে আসা পড়ুয়াদেরও বিজ্ঞান পাঠে আগ্রহ বাড়ছে। শিবিরে চুম্বক, আলোক বিজ্ঞান এবং জীব বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক হাতে কলমে শেখার সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি তারা।
যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া আত্রেয়ী ভঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিয়েছেন শিবিরে। তাঁর কথায়, "নিচু ক্লাসে বিজ্ঞান জানার আগ্রহ যাতে উঁচু ক্লাসে উঠে পড়ুয়ারা হারিয়ে না ফেলে, তা দেখা জরুরি।’’ —ছবি: নবেন্দু ঘোষ