মারধরের পরে তখনও চিকিৎসাধীন কৌশিক। —ফাইল চিত্র
‘কাজের মানুষ’ বলেই তাঁর খাতির ছিল এলাকায়। একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। মারও খেয়েছেন নিজের দফতরে। সেই ঘটনায় অভিযোগ উঠেছিল স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকেই এখনও অধরা। তবে বদলি হয়ে গেলেন সন্দেশখালি ২ বিডিও কৌশিক ভট্টাচার্য।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, নেহাতই ‘রুটিন’ বদলি। তবে বিষয়টা এত সহজ বলে মানতে পারছেন না স্থানীয় মানুষজন এবং প্রশাসনের একাংশ।
খবর চাউর হতেই শনিবার ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন এলাকার বহু মানুষ। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, গ্রামের মানুষের প্রয়োজনে পাশে পাওয়া যেত মানুষটাকে। রাত-বিরেতে মোটর বাইক নিয়েও ছুটতেন নানা দরকারে। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের ‘কাটমানি’ নেওয়ার প্রতিবাদ করায় শাসক দলের বিরাগভাজন হন তিনি। বদলিও সে কারণেই, বলছেন সন্দেশখালির মানুষজন।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সরকারি আধিকারিকদের একাংশও বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখছেন না। কৌশিককে মারধরের পরে বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকদের আস্থা ফেরাতে তাঁদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন জেলাশাসক। ব্লক ও মহকুমাস্তরের অনেক অফিসারই এ দিন নিজেদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। ব্লক স্তরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘এ ভাবে আমাদের মনোবলই নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এমন চললে আমরা স্বাধীন ভাবে কাজ করব কী ভাবে!’’
মাস দেড়েক আগে প্রহৃত হয়েছিলেন কৌশিক। স্থানীয় দু’টি পঞ্চায়েতের প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি-সহ শাসকদলের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। মারধর, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হুমকি, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, খুনের চেষ্টা-সহ একাধিক ধারায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে পুলিশ। কিন্তু ধরা পড়েনি কেউ। তবে প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জেলায় যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তাতে বলা হয়, দুর্নীতি ও কাটমানির প্রতিবাদ করার ফলেই আক্রান্ত হয়েছিলেন বিডিও।
সন্দেশখালির বিভিন্ন নদীর ফেরিঘাট থেকে আয়ের লক্ষ লক্ষ টাকার বড় অংশ কাটমানি হিসেবে নেতাদের দিতে হয় বলে অভিযোগ। আয়লা প্রকল্পের চাল, পুকুর কাটা, ঘর তৈরির প্রকল্প, একশো দিনের কাজ-সহ নানা সরকারি প্রকল্প থেকে কাটমানি এলাকার কিছু তৃণমূল নেতার পকেটে ঢুকেছে বলে জানতে পেরেছিলেন কৌশিক। সেই রিপোর্ট তিনি পাঠান জেলায়। প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, জেলাশাসকের সঙ্গে প্রশাসন ও তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের বৈঠকের পরে বেশ কিছু টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরতও দিয়েছিলেন অভিযুক্ত কয়েকজন তৃণমূল নেতা। কিন্তু তাঁদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন কৌশিক।
সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ক তথা সিপিএম নেতা নিরাপদ সর্দার বলেন, ‘‘খুবই কাজের মানুষ বিডিও। দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ না করায় তাঁকে হেনস্থা করা হয়েছিল। এ বার এলাকা থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি গণেশ ঘোষও বলেন, ‘‘শাসক দলের নেত্রী কাটমানি বন্ধের কথা মুখে বললেও কাজে তিনি তা চান না। কৌশিকের ঘটনাই তার উদাহরণ। এ ভাবে চলতে থাকলে সরকারি কর্মীদের মনোবলই ভেঙে যাবে।’’
এ বিষয়ে তৃণমূল নেতা ফিরোজ কামাল গাজির বক্তব্য, ‘‘মারধরের ঘটনায় অভিযুক্তদের ধরেছে পুলিশ। তা ছাড়া, কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নয়, স্বাভাবিক বদলিই হয়েছে ওই বিডিওর।’’ ঘটনার তদন্ত এগোচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আতাপুর গ্রামের বাসিন্দা মণীন্দ্র মিস্ত্রি, গোপাল সর্দারর বলেন, ‘‘গ্রামের কারও বিপদে-আপদে কৌশিকবাবুকে এক ডাকে পাশে পেতাম। বাঁধের অবস্থা খারাপ শুনে উনি মাঝরাতে ছুটে যেতেন। দাঁড়িয়ে থেকে ভোর পর্যন্ত কাজের তদারক করতে দেখেছি। এমন মানুষটাকেও সরে যেতে হল।’’
ধুচনেখালির বাসিন্দা স্বরূপ মণ্ডল বলেন, ‘‘একবার আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ছিল না। সে সময়ে বিডিওর পা ভেঙে গিয়েছিল। ফোনে যোগাযোগ করলে উনি ওই অবস্থায় ব্যাঙ্কে কথা বলে আমার সমস্যার সমাধান করে দেন।’’
সন্দেশখালির স্বপন দাসের কথায়, ‘‘প্রতিদিন সকালে বিডিও আমাদের সঙ্গে ক্রিকেট-ফুটবল খেলতেন। বন্ধুর মতো মিশতেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ওঁকে সরে যেতে হচ্ছে শুনে খুব খারাপ লাগছে।’’
রাজরোষে পড়েই কি বদলি হলেন?
এ প্রশ্নের কোনও জবাব দেননি কৌশিক। শুধু বলেন, ‘‘সন্দেশখালির মানুষের থেকে যে ভালবাসা পেয়েছি, তা কোনও দিন ভুলব না।’’