অভিষেকের সভার দিনে ভাঙড়ে মুড়িমুড়কির মতো পড়ল বোমা। —নিজস্ব চিত্র।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হতেই প্রতি দিন কম-বেশি অশান্ত হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়। কিন্তু মঙ্গলবার যেন সব কিছু ছাপিয়ে গেল! দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল তৃণমূল এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। ইটবৃষ্টির পাশাপাশি মুড়িমুড়কির মতো হল বোমাবাজি। উঠল গুলি চলার অভিযোগও। গুরুতর জখম হয়ে চার জন কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে এক জন গুলিবিদ্ধও রয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের বাড়ি ভাঙড়ে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ভাঙড়ের পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ছোড়ে কাঁদানে গ্যাসও।
আইএসএফ নেতৃত্বের অভিযোগ, তৃণমূল পরিকল্পিত ভাবে হামলা চালিয়েছে তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের উপরে। তৃণমূল আবার পাল্টা আইএসএফের বিরুদ্ধে ‘দুষ্কৃতী’দের নিয়ে এসে শাসকদলের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগ তুলেছে। ঘটনাচক্রে, মঙ্গলবার বিকেলেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জনসংযোগ যাত্রা’ পৌঁছেছে ভাঙড়ে। যদিও তিনি পৌঁছনোর আগেই অশান্ত ভাঙড় ‘নিয়ন্ত্রণে’ এসেছে বলেই পুলিশের দাবি। প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য না করলেও, পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, মঙ্গলবার মনোনয়ন পর্বকে ঘিরে অশান্ত হয়ে উঠেছিল ভাঙড়-২ ব্লক। আর অভিষেকের কর্মসূচি ছিল ভাঙড়-১ ব্লকে।
ভাঙড়ের চার বাসিন্দাকে গুরুতর জখম অবস্থায় কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, গুলিবিদ্ধ যুবকের নাম বাহাউদ্দিন মোল্লা। মঙ্গলবার দুপুর ১টা নাগাদ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তিনি ভাঙড়ের দক্ষিণ বামুড়িয়ার বাসিন্দা। বাহাউদ্দিনকে ‘ট্রমা অবজার্ভেশন ওয়ার্ডে’ ভর্তি করানো হয়েছে। বাহাউদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি ভাঙড় বাজারে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অন্য দিকে, আজিবুর রহমান মোল্লা, ওহিদুল মোল্লা এবং মোস্তাফা মোল্লা নামে তিন জনকেও ওই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, তাঁরাও ভাঙড়ের শ্যামনগর এলাকার বাসিন্দা। ওই তিন জনই জানিয়েছেন, গাড়িতে চড়ে ভাঙড়-২ বিডিও অফিসে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার সময় শোনপুর বাজারের কাছে আইএসএফ সমর্থকরা তাঁদের লাঠি ও বাঁশ দিয়ে মারধর করেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আজিবুর, মোস্তাফা এবং ওহিদুলের মাথায় আঘাত লেগেছে।
ভাঙড় বিধানসভায় দু’টি ব্লক— ভাঙড়-১ এবং ২। রয়েছে তিনটি থানা। কাশীপুর, ভাঙড় এবং কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স। এর মধ্যে প্রথম দু’টি থানা বারুইপুর জেলা পুলিশের আওতায়। তৃতীয়টি কলকাতা পুলিশের এক্তিয়ারভুক্ত। মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে ভাঙড়-১ এবং ২ ব্লকে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ শুরু হয়। আগে থেকেই ঠিক ছিল, দলীয় নেতা তথা ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির নেতৃত্বে আইএসএফ ও বামপ্রার্থীরা মঙ্গলবার ভাঙড়-২ বিডিও অফিসে মনোনয়ন জমা দেবেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় নওশাদের নেতৃত্বে মিছিল করে দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা ভাঙড়-২ বিডিও অফিসে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাচ্ছিলেন। ওই মিছিল বিজয়গঞ্জ বাজার এলাকায় পৌঁছনো মাত্রই তৃণমূলের একদল কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তাদের গন্ডগোল বাধে। তৃণমূলের দাবি, আইএসএফের কর্মী-সমর্থকেরাই তাদের উপরে প্রথম হামলা চালান। প্রতিবাদ করতে গেলে শাসকদলের কর্মী-সমর্থকদের ব্যাপক মারধর করা হয় বলে তৃণমূলের অভিযোগ। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, সেই সময়েই মুড়িমুড়কির মতো বোমাবাজি হয়। শোনা যায় গুলির শব্দও। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, আইএসএফের পাল্টা প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রাথমিক ভাবে তৃণমূল ব্যর্থ হয়। শাসকদলের অনেককেই স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভিতরে লুকিয়ে পড়তেও দেখেছেন তাঁরা। যদিও অন্য অংশের দাবি, সংঘর্ষ হয়েছে সমানে সমানে।
তবে বিবদমান দু’দলের দাবি, তাদের একাধিক কর্মী-সমর্থক জখম হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বেশ কয়েক জন। তৃণমূলের অভিযোগ, আইএসএফের কর্মী-সমর্থকেরা এলাকায় বিপুল বোমাবাজি করেছেন। শাসকদলের নেতা আরাবুল ইসলাম, হাকিমুল ইসলামের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তাঁদের গাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া হয় বোমা। পাশাপাশি, ভাঙচুর করা হয় বহু গাড়ি ও বাইক। আরাবুল পরে বলেন, ‘‘নওশাদ সিদ্দিকি ভাঙড়কে অশান্ত করতে বিভিন্ন জায়গা থেকে দুষ্কৃতীদের নিয়ে এসেছিলেন মনোনয়ন জমা দিতে। ওঁদের গুন্ডামিতে বহু তৃণমূল কর্মী আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধও হয়েছেন আমাদের দলের বেশ কয়েক জন। আমাদের বহু কর্মী প্রাণ বাঁচাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে লুকিয়ে পড়েছিল বলে বেঁচে গিয়েছে। আজ প্রমাণ হয়ে গেল নওশাদ এক জন দুষ্কৃতী।’’
নওশাদ যদিও আরাবুলের তোলা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘বিরোধীরা যাতে মনোনয়ন জমা দিতে না পারে, সে জন্য পরিকল্পনা করে হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। আমরা কর্মীদের আইন মেনে চলার কথা বলেছি। আজকের হামলায় যারা দোষী তাঁদের বিরুদ্ধে কমিশন ও প্রশাসন যাতে ব্যবস্থা নেয় তার দাবি জানাচ্ছি।’’
ক্যানিং (পূর্ব)-এর বিধায়ক তথা ভাঙড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা শওকত মোল্লা অভিযোগ করেছেন, তৃণমূলের ‘নবজোয়ার যাত্রা’ কর্মসূচি বাতিল করতেই সমাজবিরোধীদের একত্রিত করে পরিকল্পিত ভাবে মঙ্গলবার হামলা করেছে আইএসএফ। এ জন্য নওশাদকেই দায়ী করেছেন তিনি। এ জন্য নওশাদদের ‘চরম মূল্য’ দিতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শওকত। নওশাদ যদিও শওকতের এই অভিযোগ নিয়ে পাল্টা বলেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মসূচিতে অশান্তি করার ইচ্ছা থাকলে আমরা আজ ভাঙড়-২ ব্লকে মনোনয়নপত্র জমা দিতাম না। তা হলে আজ আমরা ভাঙড়-১ ব্লকেই মনোনয়নপত্র জমা দিতাম।’’
ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে যখন সংঘর্ষ হয় দু’পক্ষের, তখন এলাকায় কোনও পুলিশকর্মী ছিলেন না বলে অভিযোগ। কিছু পুলিশকর্মী ছিলেন বিডিও অফিসের ভিতরে মনোনয়ন জমা দেওয়ার জায়গায়। ফলে সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ যখন সেখানে পৌঁছয়, তত ক্ষণে গোলমাল অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে বলেই প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি। যদিও বিরোধীদের দাবি, অভিষেকের কর্মসূচির জন্য ভাঙড়-১ ব্লকে বেশি পুলিশ মোতায়েন করায় ভাঙড়-২ ব্লকে পুলিশের সংখ্যা কম ছিল। ফলে খবর পেয়েও গন্ডগোল থামানোর মতো পর্যাপ্ত পুলিশকর্মী ঘটনাস্থলে ছিলেন না। যার জেরে গন্ডগোল অনেক দূর গড়ায়।
দু’দলের সংঘর্ষে আহত হয়েছে পুলিশও। ইটের ঘায়ে জখম হন কাশীপুর থানার এক সাব ইনস্পেক্টর-সহ কয়েক জন পুলিশকর্মী। পুলিশ যদিও এই সংঘর্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। এমনকি, গুলি চলার কথাও মানেনি। বারুইপুর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাকসুদ হাসানের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী এলাকায় রয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘‘এলাকায় পুলিশ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে ভাঙড়ে।’’