ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া ‘ব্লাডি ড্যাডি’ ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহিদ কপূর। ছবি: সংগৃহীত।
রাজধানীর রাস্তা। ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় বলছে সাড়ে ছ’টা বেজে গিয়েছে। পাখির চোখে ধরা পড়ছে, রাস্তার উপর দিয়েই ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে কালো রঙের গাড়ি। দিল্লির রাস্তা সাধারণত সেই সময় ফাঁকা পাওয়া যায় না। কিন্তু সকলে তখন কোভিডের আতঙ্কে ঘরবন্দি। খুব প্রয়োজন না হলে বাড়ির চৌকাঠ পার করছেন না কেউই। সে রকম এক সকালে রাজধানীর রাস্তায় কালো গাড়িটি গিয়ে ধাক্কা মারল অন্য দিক থেকে আসা আর একটি কালো গাড়িতে। একাধিক বার পাল্টি খেয়ে আবার রাস্তায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটি। ঠিক যেন খেলনা গাড়ির মতো। চলল গুলিও। রাস্তায় পড়ে রইল মৃতদেহ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টেলিভিশনের সংবাদ চ্যানেলে ছেয়ে গেল এই খবর। তার পর থেকেই দিল্লির নার্কোটিক্স দফতরে ছড়িয়ে পড়ে চাঞ্চল্য। শুরু হল কখনও ভরপুর অ্যাকশন, কখনও বা ফ্যামিলি ড্রামা। এ ভাবেই এগিয়ে যায় ‘ব্লাডি ড্যাডি’ ছবির গল্প।
শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে বলি পরিচালক আলি আব্বাস জাফর পরিচালিত অ্যাকশন থ্রিলার ঘরানার ছবি ‘ব্লাডি ড্যাডি’। তবে প্রেক্ষাগৃহে নয়, ছবি মুক্তির মাধ্যম হিসাবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মকেই বেছে নিয়েছেন ছবি নির্মাতারা।
রণিত রয় (বাঁ দিকে), শাহিদ কপূর (মাঝখানে) এবং সঞ্জয় কপূর (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
‘ভারত’, ‘সুলতান’, ‘টাইগার জ়িন্দা হ্যায়’-এর মতো একাধিক হিন্দি ছবির জন্ম পরিচালকের আব্বাসের হাতে। তাই তাঁর পরিচালনায় আরও একটি ছবি মুক্তির খবর পাওয়ার পর থেকেই অধীর আগ্রহে মুখিয়ে ছিলেন দর্শক। তার উপর যখন ছবির মুখ্যচরিত্রে রয়েছেন শাহিদ কপূর, তখন প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া হওয়াই স্বাভাবিক। এককালে বলিপাড়ায় শাহিদের ‘চকোলেট বয়’ হিসাবে যে ‘ইমেজ’ ছিল, সেই ছক অভিনেতা ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলেছেন বহু দিন আগেই। ‘কমিনে’, ‘হায়দর’, ‘কবীর সিংহ’ ছবির পাশাপাশি চলতি বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ফরজ়ি’ ওয়েব সিরিজ়েও গুরুগম্ভীর চরিত্রেই অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে শাহিদকে। ‘ব্লাডি ড্যাডি’ ছবিতেও সেই চেনা ছকেই ফিরলেন অভিনেতা।
ফ্রেডেরিক জার্দিন পরিচালিত ‘স্লিপলেস নাইট’ ফ্রেঞ্চ ছবির চিত্রনাট্যের উপর ভিত্তি করে আলি আব্বাস ‘ব্লাডি ড্যাডি’ ছবিটি বানিয়েছেন। আট বছর আগে একই চিত্রনাট্যের উপর ভিত্তি করে একটি তামিল অনুকরণ হয়েছিল। সেই ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল কমল হাসনকে। পুরনো গল্পই আবার একই ধাঁচে বুনেছেন আলি আব্বাস। তাঁর সঙ্গে চিত্রনাট্য নির্মাণের কাজে হাত লাগিয়েছেন আদিত্য বসু এবং সিদ্ধার্থ-গরিমা জুটি।
‘ব্লাডি ড্যাডি’ ছবির একটি দৃশ্যে শাহিদ কপূর। ছবি: সংগৃহীত।
চিত্রনাট্যে সামান্য বদল করা হয়েছে বলে ক্যামেরায় ধরা পড়েছে করোনা পরিস্থিতি। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর বিশ্ববাসী এক দিকে যেমন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন, ঠিক তেমনই অন্য দিকে অন্ধকারের আড়ালে বাসা বাঁধছিল অপরাধ, মাদকের চোরাকারবারি। এই গল্পই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিতে। বাস্তবের সঙ্গে মিল রাখার জন্য কখনও মাস্কের ব্যবহার, কখনও বা করোনা পরীক্ষা সংক্রান্ত খুঁটিনাটির দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। যে হেতু খুব কম বলিউড ছবিতে কোভিডের ছায়া পড়েছে, পর্দায় বাস্তবের ছবি দেখতে মন্দ লাগে না।
এই ছবিতে নার্কোটিক্স দফতরের আধিকারিকের চরিত্রে শাহিদের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন ডায়না পেন্টি, রাজীব খন্ডেলওয়াল এবং জ়িশান কাদ্রি। মাদক ব্যবসায়ীর চরিত্রে দেখা গিয়েছে সঞ্জয় কপূর এবং রণিত রয়কে। ছবির গল্পের কেন্দ্রবিন্দু মূলত সুমের আজ়াদের জীবন এবং করোনাকালে মাদকপাচার সংক্রান্ত একটি ঘটনা। সেই সুমেরের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন শাহিদ।
‘ব্লাডি ড্যাডি’ ছবির দৃশ্যে বলি অভিনেত্রী ডায়না পেন্টি। ছবি: সংগৃহীত।
পেশাগত জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নিজের ছেলেকেই সময় দিতে পারছিল না সুমের। বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল বহু দিন আগেই। প্রেমিকের সঙ্গে একত্রবাসে রয়েছে সুমেরের প্রাক্তন স্ত্রী। ছেলে বাবার কাছে থাকলেও তার সঙ্গেও ক্রমশ দূরত্ব তৈরি হচ্ছে তার। পেশাগত জীবনের প্রভাব এসে পড়ে সুমেরের ছেলের উপরও। অপরাধীদের হাত থেকে মাদক নিয়ে সরে পড়ায় অপহরণ করা হয় সুমেরের ছেলেকে।
এক দিকে ভালবাসার মানুষ, অন্য দিকে পেশাগত দায়িত্ব। কী ভাবে দুই দিক বজায় রাখবে সুমের? শুধুমাত্র ছেলেকে বাঁচিয়ে ফিরে আসবে? না কি তার পাশাপাশি ফাঁস করবে নার্কোটিক্স দফতরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আসল ‘দোষী’কে? এ নিয়েই এগিয়ে যায় গল্প। কখনও পর্দায় জমজমাট অ্যাকশন, কখনও আবার ফ্যামিলি ড্রামায় ভরপুর। তার মধ্যে খানিকটা হাস্যরসেরও ছোঁয়াও রয়েছে। অ্যাকশন ছবি বানাতে যে সব উপাদান প্রয়োজন, ‘ব্লাডি ড্যাডি’তেও সে সব মশলা ছিল। উপকরণের অভাব না থাকা সত্ত্বেও বার বার যেন তাল কাটল ছবির। কখন গল্পের গতি ধীর, আবার কখনও ঘোড়ার বেগে ছুটে গিয়েছে গল্পের গতি। তাই কোথাও কোথাও তাল কাটতে বাধ্য।
কাহিনি যতটা জোরদার, সেই অর্থে চরিত্র বুননে জোর দেওয়া হয়নি। শাহিদ কপূরের অ্যাকশন অবতার দর্শক আগেই দেখেছেন। সেখানে কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু পর্দায় সুমেরের সঙ্গে তার ছেলের সম্পর্কের রসায়ন ঠিক যেন ফুটল না।
শাহিদ বরাবরের মতো দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন এই ছবিতে। কিন্তু ছবি দেখার সময় বার বার যেন মনে হয়, এই একই ধরনের অভিনয় ‘কবীর সিংহ’ বা ‘ফরজ়ি’তেও করেছিলেন অভিনেতা। কোথাও যেন শাহিদের এই চেনা ছকে বাঁধা চরিত্র ভাল লাগলেও চোখে নতুন কিছু ধরা পড়বে না। কখনও কখনও ‘জন উইক’-এর সঙ্গেও মিল খুঁজে পেতে পারেন দর্শক।
খলনায়কের চরিত্রে সঞ্জয়ের অভিনয় যথাযথ। তবে রণিতের অভিনয় আলাদা ভাবে নজর কেড়েছে। ছবির সবচেয়ে মজার সংলাপগুলি তাঁর মুখে বসানো হয়েছে। রাজীবের সংলাপে গালমন্দের ব্যবহারে এতই আধিক্য দেখা যায় যে, তা চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। ডায়না পর্দায় খুবই কম সময় পেয়েছেন। তাঁর চরিত্রটি কি সত্যিই এত বোকা? না কি তার নেপথ্যে কোনও গল্প রয়েছে। এই চরিত্র নির্মাণের উপর বেশি জোর দিলে ভাল হত।
‘ব্লাডি ড্যাডি’ ছবিতে শাহিদের অভিনয় চেনা ছকে বাঁধা হলেও ছবিতে ভালই অভিনয় করেছেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত।
অ্যাকশন এবং ড্রামা, সব মিলিয়ে ‘ব্লাডি ড্যাডি’ একটি আপাদমস্তক বিনোদনমূলক সিনেমা। র্যাপার বাদশার একটি গানও রয়েছে ছবিতে। কিন্তু সেই গানের সঙ্গে যে সিকোয়েন্সটা দেখানো হয়, তা যেন খানিকটা জোর করে ঢোকানো। পাশাপাশি দিল্লির উচ্চবিত্তের কাছে করোনার প্রভাব ঠিক কী রকম ছিল, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নির্মাতারা।
বিয়েতে ডিজে যখন ডান্স ফ্লোরে সকলকে ‘গো করোনা গো’ শব্দবন্ধের সঙ্গে করতালি দেওয়ার নির্দেশ দেয়, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের অর্থকষ্ট, পরিযায়ী শ্রমিকদের ভোগান্তি, বহু মানুষের জীবিকা সংশয়— সব এক মুহূর্তে যেন হারিয়ে যায়। কোভিডকালে দেশে দুর্নীতি কতটা বেড়ে যায়, সেই নিয়েও মন্তব্য করে ছবির চিত্রনাট্য। কে ভাল, কে মন্দ— অ্যাকশনের ভিড়ে মিলিয়ে যাবে গল্পে। শাহিদের অভিনয় এবং চিত্রনাট্যের জন্য এই ছবিটি এক বার অন্তত দেখাই যেতে পারে।