ছবি: এএফপি।
শনিবার সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল অবিশ্রাম বৃষ্টি। সঙ্গী, হালকা ঝোড়ো হাওয়া। চাষ বিলম্বে হওয়ায়, হিঙ্গলগঞ্জের সমস্ত একফসলি মাঠে কাঁচাপাকা ধান সকালবেলাতেও দাঁড়িয়ে ছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকল বৃষ্টি আর হাওয়ার দাপট। চোখের সামনে জমির পর জমির ধান লুটিয়ে পড়তে লাগল মাটিতে। চাষিরা জানলেন, এবছরও ধানের একটা দানাও আর ঘরে উঠবে না! সেই সঙ্গে মাথার ছাউনিটাও হয়ত হারিয়ে যেতে পারে আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ে! তাই ঘনঘন তাঁরা খবর নিচ্ছিলেন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে! বিডিও অফিস, পঞ্চায়েত, থানা থেকে শুরু হয়েছিল মাইক প্রচার। সন্ধ্যের মধ্যেই কাঁচা-বাড়ির বাসিন্দাদের একে একে নিয়ে আসা হচ্ছিল হেমনগর থেকে কনকনগরের বিভিন্ন সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে। আশপাশের স্কুলগুলোতেও উঠে আসছিলেন আতঙ্কিত বাসিন্দারা। টানা লোডশেডিং-এ বন্ধ হয়ে আসছিল সবার হাতের মোবাইল ফোন। স্তব্ধ হচ্ছিল সবরকম যোগাযোগ ব্যবস্থা।
রাত তখন সাড়ে ন’টা। দমকা হাওয়া উঠল। তারপরেই মুষলধারে শুরু হল বৃষ্টি। এলাকার আশপাশের ডোবা-পুকুরগুলো আগেই কানায়-কানায় পূর্ণ ছিল। ঘন্টা খানেকের টানা বৃষ্টিতে সব ভেসে যেতে লাগল। ওইসব পুকুরগুলোতে সামান্য আয়ের জন্য মাছ চাষ করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের শেষ আশা-ভরসাটুকুও আর থাকল না।
পঞ্চায়েত বিডিও অফিস থেকে কোথাও শুকনো চিঁড়ে-বাতাসা, কোথাও খিচুড়ি খাওয়ানো হল ফ্লাড শেল্টারে আটকে থাকা অসংখ্য মানুষকে। বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ খানিক শান্ত হল বৃষ্টি। হাওয়া কমল। সবাই ধরে নিলেন, নিষ্ক্রিয় হয়েছে ‘বুলবুল’! কিন্তু সে আর কতক্ষণ!
রাত তিনটে থেকে ঝড়ের শোঁ-শোঁ শব্দে জেগে উঠলেন সবাই। একটার পর একটা গাছ ভেঙে পড়তে লাগল। বিদ্যুতের খুঁটিগুলো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছিল রাস্তায়। টালি-অ্যাসবেস্টসের চালে এসে পড়ছিল ভাঙা গাছের ডাল। অসহায়ের মতো দেখা করা ছাড়া এ সময় আর কিছুই করার ছিল না!
সকালের আলো ফুটতেই দেখা গেল রাস্তার উপর আড়াআড়ি উপড়ে পড়ে আছে গাছের পর গাছ। অনেকের ঘর দোকানের টিন লুটোপুটি খাচ্ছে রাস্তায়। মাঠের ধান একেবারে মিশে গেছে মাটিতে। পুকুর ছাপিয়ে সব মাছ ভেসে গেছে। ঘর চাপা পড়ে অসহায় বৃদ্ধার মৃত্যুর খবরও এসেছে হিঙ্গলগঞ্জে। যে পঙ্গু অর্থনীতি সুন্দরবনকে তাড়া করে বেড়ায় সারা বছর, আরেকটা ‘বুলবুল’ ঝড়ের তাণ্ডব, সেই অর্থনীতিকে আর একবার ধরাশায়ী করে গেল!
প্রকৃতির ধ্বংসলীলার কাছে বারবার পর্যুদস্ত হতে হয় সুন্দরবন অঞ্চলের এই হিঙ্গলগঞ্জকে। ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের কাছে সহজেই ভেঙে পড়ে এখানকার অর্থনীতি। বিপন্ন হয়ে ওঠে ইছামতি, গৌড়েশ্বর, রায়মঙ্গল নদী-ঘেরা এক বিস্তীর্ণ দ্বীপ-অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ প্রকৃতি। বিপর্যস্ত হয় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। দলে দলে মানুষ বাধ্য হন তাঁদের বাস্তুভিটা ছেড়ে, সামান্য রোজগারের আশায়, ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে। স্কুলগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ‘ড্রপ আউট’। যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর শিকেয় ওঠে এখানকার পড়াশোনা। সামান্য ‘সরকারি ত্রাণ’-এর আশায় পঞ্চায়েত-বিডিও অফিসের সামনে ভিড় জমান তফসিলি জাতি-উপজাতি অধ্যুষিত হিঙ্গলগঞ্জের অসংখ্য কাজ হারানো মানুষ। প্রকৃতি যত রুষ্ট হয়, হিঙ্গলগঞ্জের অসহায় মানুষের লাইন, সরকারি অফিসের সামনে ততই লম্বা হতে থাকে। ২০০৯ সালের আয়লায় যেমনটা হয়েছিল!
এই ‘বুলবুল’ তাণ্ডবের পর, এই মূহুর্তে জানা নেই, কীভাবে মেরামত হবে অসংখ্য ঘর। জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হওয়ায়, কীভাবে মিটবে হিঙ্গলগঞ্জের চাষিদের ধার-দেনা। কবে থেকে নিশ্চিন্তে স্কুলে যেতে পারবে হিঙ্গলগঞ্জের শিশুরা! প্রকৃতির রোষের কাছে বারবার এভাবে নাস্তানাবুদ হয়ে, কার কাছে অভিযোগ জানাবে হিঙ্গলগঞ্জ? বিকল্প অর্থনীতি, নাকি ‘সরকারি ত্রাণ’, কার ভরসায় বছরের পর বছর অপেক্ষা করবে এখানকার মানুষ? ইছামতি-কালিন্দী, গৌড়েশ্বর, রায়মঙ্গল ঘেরা এই দ্বীপভূমির করুণ আর্তনাদ আদৌ কি পৌছাবে সরকারের কাছে? মিলবে কি কোনো স্থায়ী সমাধান? নাকি শুধুই ‘ত্রাণ’ আর অনেকগুলো লম্বা লাইন?