গেরুয়া-ঝড়ে যখন রাজ্যের প্রায় অর্ধেক জেলায় শাসকদলের অবস্থা টলমল, তখন দক্ষিণ ২৪ পরগনায় শুধু দুর্গ ধরে রাখাই নয়, শাসকদলের অবস্থান সেখানে আরও পোক্ত হল। গত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের নিরিখে সেখানে কয়েক শতাংশ ভোটও বাড়িয়ে নিতে পেরেছে তৃণমূল।
এর মধ্যে বজবজ পুরসভার একাংশ এবং প্রায় পুরো ডায়মন্ড হারবার পুরসভা ভোটের নিরিখে বিজেপির দখলে চলে গিয়েছে। এটুকু বাদ দিলে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তৃণমূলের অবস্থা মোটের উপরে ভালই।
রাজ্য-জোড়া ভাঙনের আবহে কী করে এটা সম্ভব হল?
তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতার কথায়, ‘‘একদিকে মেরুকরণ, অন্য দিকে শাসকদলের প্রতি ক্ষোভ— একে পুঁজি করেই রাজ্য জুড়ে নিজেদের ভোট বাড়িয়েছে গেরুয়া-শিবির। দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও প্রেক্ষাপটটা একই ছিল। কিন্তু এখানে মেরুকরণ কাজ করেনি। রাজ্য জুড়ে যেমন বাম-ভোটের বড় অংশ বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও তাই হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে শাসকদলের ৫-৭ শতাংশ ভোট বেড়েছে।’’
কী ভাবে?
রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, অন্য অঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভোটারের জাতিবিন্যাসটা আলাদা। এখানে যেহেতু বাম ভোটারদের একটা বড় অংশ সংখ্যালঘু, ফলে তাঁদের ভোটটা পুরোপুরি বিজেপি শিবিরের দিকে যায়নি। হিন্দু-ভোট বিজেপিতে গেলেও মুসলিম-ভোটটা ঘুরে তৃণমূলেই গিয়েছে। আর সে কারণেই তৃণমূলের এই ভোট-বৃদ্ধি।
ডায়মন্ড হারবার, জয়নগর, যাদবপুর, মথুরাপুরে বিধানসভাভিত্তিক ফলাফল ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, এই অঞ্চলে গত বিধানসভা ভোটে বিভিন্ন আসনে শাসকদলের যা মার্জিন ছিল, সেই ব্যবধান তৃণমূল এ বারে গড়ে প্রায় দ্বি-গুণের কাছাকাছি নিতে যেতে পেরেছে। চারটি লোকসভা আসনের ২৮টি বিধানসভাতেই গড়ে প্রায় সম-হারে ভোট বেড়েছে শাসকদলের বলে জেলা নির্বাচন দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের দাবি, উন্নয়নকে মাথায় রেখেই এখানে শাসকদলকে ভোট দিয়েছেন মানুষ। বাম-ভোট বিজেপির ঝুলিতে যাওয়া সত্ত্বেও তাই শাসকদলের কোনও ক্ষতি হয়নি। গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে বিজেপি তৃতীয় স্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে এসেছে। বামফ্রন্ট দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় স্থানে গিয়েছে।
জেলা নেতৃত্বের দাবি, গত পাঁচ বছরে জেলায় মুখ্যমন্ত্রী একের পর এক প্রশাসনিক সভা করেছেন। সুন্দরবন-সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের উন্নয়ন নিয়ে সরাসরি নজরদারি করেছেন। এর সুফল মিলেছে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে। নানা পরিষেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তাই বিজেপি-সহ বিরোধী ভোট সবটাই শাসকদলের পক্ষে গিয়েছে।
কিন্তু এ হেন ব্যাখ্যা মানতে নারাজ জেলার বিরোধী নেতারা।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ি বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসনের এক শ্রেণির আধিকারিক ও শাসকদলের যোগসাজশেই এখানে ভোট হয়েছে।’’ শমীকের কথায়, ‘‘প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রের কয়েকটি বিধানসভাকে আগে বেছে নেওয়া হয়েছে। পরে সেগুলিতে সন্ত্রাস চালিয়ে সেখানে মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। ওই একটি করে বিধানসভার ফলের নিরিখেই লোকসভা কেন্দ্রের ভোটের শতাংশ বেড়েছে।’’ বিরোধীদের আরও অভিযোগ, যাদবপুর কেন্দ্রের ভাঙড় বিধানসভা, জয়নগর কেন্দ্রের ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা, ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের ফলতা বিধানসভা, মথুরাপুর কেন্দ্রের কাকদ্বীপ ও পাথরপ্রতিমায় মানুষকে ভোট দিতেই দেওয়া হয়নি। ওই বিধানসভাগুলিতে তাই শাসকদলের ভোটের হার প্রায় ১০০ শতাংশ। শমীক বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনে নির্দিষ্ট বুথভিত্তিক অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা কোনও পদক্ষেপ করেনি। ওই সব বুথে মানুষ ভোট দিতে পারেননি। যদিও বা দিয়েছেন, শাসকদলের এজেন্টকে দেখিয়ে তবেই ভোট দিতে পেরেছেন তাঁরা। বিরোধী এজেন্টকে মারধর করে তুলে দেওয়া হয়েছে।’’ শমীকের দাবি, উন্নয়নের নিরিখে আদৌ ভোট হয়নি। শাসকদল সন্ত্রাস করে ভোট লুট করে ঝুলি ভরিয়েছে।
জেলা বিজেপি সভাপতি অভিজিৎ দাসের কথায়, ‘‘নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই গোটা জেলায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। বিরোধী নেতা-সমর্থককে মারধর করে ও তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছিল। নির্বাচনের দিনে সন্ত্রাস ঠেকাতে কোনও ভাবেই যাতে বিরোধী নেতা-কর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারেন।’’ সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এক দিকে ভোট লুট, আর এক দিকে বামেদের দখলে থাকা সংখ্যালঘু ভোট শাসকদলের ঝুলিতে যাওয়া— এর যোগফলেই তৃণমূলের ভোট বেড়েছে।’’
তবে বিরোধীদের এই বিশ্লেষণ বা অভিযোগকে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি শুভাশিস চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘মানুষের সমর্থন না পেয়ে বিরোধীরা এখন নানা রকম গল্প ফেঁদেছেন। এখানে ভোট উন্নয়নের নিরিখেই হয়েছে। উন্নয়নই আমাদের জিতিয়েছে।’’