প্রতীকী ছবি।
একে দামের বোঝা, তার উপরে নিয়মের ফাঁস— সব মিলিয়ে কার্যত বন্ধ হওয়ার জোগাড় ছোট ও মাঝারি সোনার গয়নার দোকান। বার বার সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদনেও সুরাহা হয়নি। তার ফলে জেলায় জেলায় ঝাঁপ পড়ছে অসংখ্য ছোট দোকানে।
গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে অলঙ্কার ব্যবসায়। প্রথমে প্যান নম্বর দিয়ে গয়না কেনা, পরে ধাপে ধাপে হলমার্ক, জিএসটি-সহ একাধিক নিয়ম চালু হয়েছে। তার উপরে গত কয়েক মাসে সোনার দাম বাড়তে বাড়তে দশ গ্রামের দাম হয়েছে ৪২ হাজার টাকা!
স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দাবি, দামের কারণে এমনিতেই ব্যবসা তলানিতে। তার উপরে নতুন নতুন নিয়মের জেরে ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে রোজগারের জন্য অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। অনেকে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়ছেন। স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন থেকে কেন্দ্র সরকারের কাছে বার বার আবেদন-নিবেদন করেও লাভ হয়নি। উল্টে হলমার্ক ছাপের যে ব্যবসা শুরু হয়েছে, তাতে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
বঙ্গীয় স্বর্ণ শিল্পী সমিতির রাজ্য কমিটির সদস্য অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে এখন সোনার ব্যবসা মানে শাস্তির সমান। এমনিতেই ব্যবসা তলানিতে। তার উপরে নিয়ম-কানুন গলার ফাঁস হয়ে বসছে, আমাদের গলায়।’’
সোনার ব্যবসায়ীরা প্রথমেই বলছেন, সোনার দামের কথা। অভিজিৎ জানান, আগে সোনার উপরে আমদানি শুল্ক ছিল ১ শতাংশ। পরে সেটা ৬ শতাংশ করা হয়। তার পরে ৮ এবং বর্তমানে ১২ শতাংশ হারে সোনার উপরে আমদানি শুল্ক আদায় করা হয়। এর ফলে সোনার দাম চড়ছে। অতিরিক্ত দামের জন্য অনেকেই গয়না কিনতে পারছেন না। যাঁরা অল্প গয়না কেনেন, তাঁরা মূলত ছোট দোকানের খদ্দের। তা-ও অনেকেই কেনাকাটা অনেক কমিয়ে ফেলেছেন।
সোনার ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে ছোট দোকানগুলির ব্যবসা তলানিতে। ব্যবসায়ীদের দাবি, আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলে সোনার দাম কিছুটা কমলে গয়না সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসে।
এরপরে আবার রয়েছে নিয়মের গেরো। প্রথমে চাপ এসেছিল জিএসটি নম্বর নেওয়ার জন্য। তারপরে আন্দোলনে নেমেছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। সেই আন্দোলনের জেরে সমস্যার কিছুটা সুরাহা হয়। শেষ পর্যন্ত নিয়ম হয়েছে, যে সব দোকানের বার্ষিক ব্যবসা ৪০ লক্ষের কম, তাদের জিএসটি নম্বর দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু বিআইএস (ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড) রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তাতে কী অসুবিধা?
অভিজিৎ বলছেন, বিআইএস নম্বর নিতে গেলে জিএসটি নম্বর থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তার সঙ্গে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে গয়নায় হলমার্ক ছাপ। জিএসটি নম্বর নিতে অসুবিধা কোথায়? তাতে তো তেমন কোনও খরচ নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘‘জিএসটি নম্বর থাকলে প্রতি দিন, বা সপ্তাহান্তে বিকিকিনির হিসেব অনলাইনে দাখিল করতে হবে। আর তা করতে গেলে একজন পেশাদার লোক রাখতে হবে। এমন অনেক ছোট দোকান রয়েছে, যাদের পক্ষে পেশাদার কাউকে মাইনে করে রেখে এই কাজ করানো কার্যত অসম্ভব।’’
এ বার আসছে হলমার্ক। সোনার বিশুদ্ধতার জন্য গয়নার উপরে এই ছাপ মারা হয়। সে জন্য বিভিন্ন জায়গায় সেন্টার খোলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলি সবই বেসরকারি। সরকার তাদের লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু তারা যে ঠিকঠাক কাজ করবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আবার বিআইএস দফতর থেকে সোনার দোকানে হানা দিয়ে গয়না তুলে নিয়ে যাচ্ছে মুম্বইয়ে হলমার্কের সদর দফতরে পাঠানোর জন্য। ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, তা হলে এত সেন্টার খুলে লাভ কী হল? আর তাদের নিয়ে যাওয়া গয়না ফেরত পেতে নাকাল হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, অনেক বাড়িতেই পুরনো গয়না রয়েছে, সেগুলি ভেঙে বা বদলে অনেকে নতুন গয়না নেন। কিন্তু সেগুলি হলমার্ক যুক্ত নয়। সে ক্ষেত্রে কী হবে, নিয়ম এখনও স্পষ্ট নয়। আর্থিক সঙ্গতি যাদের ভাল নয়, তাঁরা অনেকেই ব্রোঞ্জের চুরি বানিয়ে নেন। হলমার্ক বাধ্যতামূলক হলে তাঁরা মুশকিলে পড়বেন। এখনও অনেক দোকানে এক হাজার টাকার মধ্যে গয়না পাওয়া যায়। হলমার্ক বাধ্যতামূলক হলে তা আর মিলবে না। অভিজিৎ বলেন, ‘‘আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুরোধ করেছি, যাতে এই নিয়ম চালু করার আগে আরও অন্তত এক বছর সময় দেওয়া হোক। তার আগে নিয়ম ঘিরে যে সব প্রশ্ন রয়েছে, তার সমাধান করা হোক। আমরা হলমার্কের পক্ষে। তবে নিয়মের সরলীকরণ চাইছি।’’