Serial Killing

গাছের ‘সিরিয়াল কিলিং’?  তদন্ত চান ক্ষুব্ধ বনগাঁবাসী

হাবড়া থানার কুমড়া পঞ্চায়েতের বাঘাডাঙা মোড় থেকে মাকালতলা যাওয়ার রাস্তার দু’ধারে ২১টি গাছের অকাল মৃত্যু ঘটেছিল।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র  

বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:১৬
Share:

বনগাঁর বাজিতলা এলাকায় বনগাঁ-বাগদা সড়কের পাশে এই গাছগুলির রহস্যজনক মৃত্যু ঘটছে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

একের পর এক রহস্যমৃত্যু। যেন গোয়েন্দা গল্পে ‘সিরিয়াল কিলিং’!

Advertisement

মানুষ নয়, পর পর গাছের মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন বনগাঁর পরিবেশপ্রেমীরা। গত দু’বছরে মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে রাস্তার দু’পাশে প্রচুর গাছের রহস্য-মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসেছে। এ বার বনগাঁ মহকুমার বনগাঁ-বাগদা সড়কের দু’পাশে থাকা বেশ কিছু গাছের মৃত্যুর ঘটনায় মন খারাপ পরিবেশপ্রেমীদের। ক্ষুব্ধ পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, কী কারণে গাছ মারা গিয়েছিল, কোনও চক্র জড়িত কি না কিছুই জানা যায়নি। কোনও তদন্ত হয়নি বলে অভিযোগ। বন দফতরের বনগাঁর রেঞ্জ অফিসার সঙ্গীতা ভৌমিক বলেন, ‘‘বনগাঁ-বাগদা সড়কে গাছের মৃত্যুর খবর জানা নেই। খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ করা হবে।’’

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বনগাঁ থানার বাজিতলা এলাকায় রাস্তার দু’ধারে থাকা গোটা ২০ শিরীষ গাছের মধ্যে অনেকগুলিই মারা গিয়েছে। কয়েকটি মৃত্যুর মুখে। বাজিতলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেল একের পর এক গাছ মৃতপ্রায়। জ্যান্ত, সতেজ গাছগুলি এখন পাতাহীন। কঙ্কালের মতো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে।

Advertisement

গাছের মৃত্যুমিছিল এলাকায় নতুন নয়। এর আগে একই ভাবে গাইঘাটার ঝাউডাঙা পঞ্চায়েত এলাকায় রামনগর রোডের দু’পাশে থাকা ৩২টি গাছ মারা গিয়েছিল। ওই একই রাস্তার দু’পাশে রামনগর পঞ্চায়েত এলাকাতেও কিছু গাছ মারা গিয়েছিল। হাবড়া থানার কুমড়া পঞ্চায়েতের বাঘাডাঙা মোড় থেকে মাকালতলা যাওয়ার রাস্তার দু’ধারে ২১টি গাছের অকাল মৃত্যু ঘটেছিল। বসিরহাট মহকুমার মাটিয়া থানা এলাকাতেও একই ভাবে অনেক গাছের মৃত্যু হয়েছিল। যশোর রোডে দু’পাশেও কয়েকটি প্রাচীন গাছের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনও তদন্ত না করেই মরা গাছগুলি কেটে দিয়েছিল বলে অভিযোগ।

গাছের মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। অবসরপ্রাপ্ত জীববিজ্ঞানের শিক্ষক তথা পরিবেশকর্মী অজয় মজুমদারের কথায়, ‘‘কিছু ছত্রাকের সংক্রমণে স্থানীয় ভাবে গাছের মৃত্যু হয়। যে অঞ্চলে গাছের মৃত্যু হয়, সেখানকার সংক্রামিত গাছের বাকল তুলে এনে অন্য গাছের বাকল তুলে ঢুকিয়ে দিলে সংক্রমণ শুরু হয় এবং পরে গাছ মরে যেতে পারে।’’ অন্য আশঙ্কার কথাও শুনিয়েছেন অজয়। তিনি বলেন, ‘‘গাছের শিকড়ে ডিজ়েল ঢেলে দিলেও গাছ মারা যায়। কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই কাজ চলছে, এমনটা হতে পারে। প্রাকৃতিক ভাবেও গাছ মারা যেতে পারে। তবে সে আশঙ্কা এ ক্ষেত্রে খুবই কম। শাসনে রাস্তার উপরে অন্তত শ’তিনেক গাছ সার দিয়ে মারা গিয়েছে। কারণ আজও জানা যায়নি।’’ তাঁর দাবি, সাম্প্রতিক সময়ে জেলায় যতগুলি গাছের মৃত্যু হয়েছে, তার কারণ জানতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত।

পরিবেশকর্মীদের অনেকের দাবি, সাইটালিডিয়াম ডিমিডিয়াটাম ছত্রাকের আক্রমণে ডাইব্যাক রোগের সৃষ্টি হতে পারে। এই রোগে বর্ধমানে একের পর এক শিরীষ গাছ মারা গিয়েছিল। মানুষের দেহেও এর সংক্রমণ ঘটতে পারে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা। পশ্চিমবঙ্গে একাধিক চা বাগানে এই ছত্রাকের আক্রমণের ফলে চা শ্রমিকদের হাত-পায়ের নখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে তাঁদের দাবি।

অজয়ের মতে, ‘‘মধ্যপ্রাচ্যের ওমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সাইটালিডিয়াম ডিমিডিয়াটাম ছত্রাকই শিরীষ গাছের মৃত্যুর কারণ। এই ছত্রাক আট ধরনের গাছের উপরে হামলা চালাচ্ছে। এই ছত্রাকের আক্রমণ শুরু হতেই পলিফাঙ্গাস আক্রমণ চালায়। গাছ ছাতুর মতো গুঁড়ো হয়ে যায়। এক সময়ে ভেঙে পড়ে।’’

পরিবেশপ্রেমীদের দাবি, অবিলম্বে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সমীক্ষা করে এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন৷ দুষ্কৃতীরা এই ছত্রাক সংগ্রহ করে গাছের কাণ্ডে খানিকটা গর্ত করে তা ছড়িয়ে দিলে পুরো গাছে সংক্রমণ ধরে যেতে পারে বলে পরিবেশপ্রেমীদের আশঙ্কা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, শিরীষ গাছগুলি কয়েক মাস আগেও সতেজ ছিল। এখন রহস্যময় ভাবে মারা যাচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে মনে করছেন, গাছের অকাল মৃত্যুর পিছনে কাঠ পাচারকারীদের হাত থাকতে পারে। তারাই রোগবাহী ছত্রাক ব্যবহার করে গাছের মৃত্যু ঘটাতে পারে বলে তাঁদের অনুমান। বাসিন্দাদের অনেকের প্রশ্ন, ‘‘প্রাকৃতিক কারণেই যদি গাছের মৃত্যু হয়ে থাকে, তা হলে বাকিগুলি সুস্থ আছে কী করে! গাছ মারার পিছনে মানুষেরই ভূমিকা আছে।’’ ওই এলাকায় দোকানপাট, ট্রাক রাখার পার্কিং তৈরি হয়েছে। মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। ব্যক্তিস্বার্থে মানুষ গাছগুলি মেরে ফেলতে পারে বলেও পরিবেশকর্মীরা আশঙ্কা করছেন।

গাছের মৃত্যুতে ঝুঁকিও বেড়েছে। বনগাঁ-বাগদা সড়ক দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করা মানুষ, যানবাহন চালকেরা জানালেন, ‘‘যাতায়াতের সময়ে খুবই আতঙ্কে থাকি। কারণ, মরা গাছের ডাল ভেঙে ঝুলে আছে। যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে।’’ ঝুলন্ত ডাল কেটে ফেলার দাবিও তুলেছেন তাঁরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement