বিভিন্ন ধরনের গাড়িতে স্কুলে যাতায়াত করে শিশুরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক ও সুজিত দুয়ারি।
কখনও বেপরোয়া গতিতে ছোটে স্কুলগাড়ি। কখনও গাড়ির কাগজপত্রে গরমিল। চালকের বদলে খালাসির হাতে স্টিয়ারিং পড়ে বলেও অভিযোগ। কোনও কোনও সময়ে আবার খুদে পড়ুয়াদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও ওঠে চালক-খালাসির বিরুদ্ধে। কোথাও আবার ইঞ্জিন ভ্যান, রিকশায় ছাউনি লাগিয়েও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিপজ্জনক ভাবে যাতায়াত চলে। কী পরিস্থিতিতে চলছে মফস্সলের স্কুলগাড়ি, খোঁজ নিল আনন্দবাজার।
স্কুলে যাতায়াতের পথে কচিকাঁচাদের ভরসা যে গাড়ি, তার রুট পারমিট-ই নেই পরিবহণ দফতরের!
গোপালনগর এলাকায় খোঁজ মিলল এমন গাড়ির। ওই গাড়িতে যাতায়াত আইনসম্মত নয়, বিপজ্জনকও—জানাচ্ছেন পরিবহণ দফতরের কর্তারা। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা শীঘ্রই পুলকারের পারমিট থাকা গাড়িতেই পড়ুয়াদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করবেন।
হুগলির পোলবায় দিল্লি রোডে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নয়ানজুলিতে পড়ে ১৬ জন পড়ুয়া জখম হয়েছে। ঘটনার পরে পুলকার ও স্কুল গাড়িতে পড়ুয়ারা কতটা নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বনগাঁ, হাবড়া, অশোকনগর, গোবরডাঙা-অশোকনগর এলাকায় আইন না মেনে চলছে অনেক স্কুলগাড়ি। অভিযোগ, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা অভিভাবকদের সচেতনতারও অভাব রয়েছে বিষয়টি নিয়ে। গোপালনগর এলাকায় সম্প্রতি একটি স্কুল গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে বাইক চালকের মৃত্যু হয়।
নিয়ম-কানুন
স্কুলগাড়িকে পরিবহণ দফতর থেকে আলাদা পারমিট ভাবে নিতে হয়। গাড়িতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। পুলকারে গাড়ির সিটের নীচে ছাত্রছাত্রীদের ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নিয়মিত গাড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়। পুলকারে চালক সহযোগীর সঙ্গে একজন সহায়ক থাকা বাধ্যতামূলক। ( সূত্র, পরিবহণ দফতর)
পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, পড়ুয়াদের নিয়ে যাতায়াত করতে হলে দফতর থেকে গাড়ির নির্দিষ্ট পারমিট নিতে হয়। গাড়িতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, সহায়ক (অ্যাটেন্ডেন্ট) থাকা বাধ্যতামূলক। গাড়ির সিটের নীচে ছাত্রছাত্রীদের ব্যাগ রাখার জায়গা থাকার নিয়ম। চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক।
কিন্তু এই সমস্ত নিয়ম বেশিরভাগ গাড়িই মেনে চলে না বলে অভিযোগ। হাবড়া-অশোনগর এলাকার কয়েকজন অভিভাবক জানালেন, স্কুলগাড়ি অনেক সময়ে বেশি জোরে চলে। এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘একবার চালক আচমকা এত জোরে ব্রেক কষেছিলেন, ছেলেমেয়েরা ছিটকে সিট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরে গাড়ির চালক ধীর গতিতে গাড়ি চালান।’’ এক মহিলা অভিভাবকের কথায়, ‘‘গাড়িতে থাকা চালকের সহকারীরা বাচ্চাদের ওঠানো নামাতে অনেক সময়ে দুর্ব্যবহার করেন।’’ একটি স্কুলের শিক্ষক বলেন, ‘‘অভিযোগ পেয়ে আমরা চালকের সহযোগীকে কাজ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম।’’
বনগাঁ কালুপুরে সিগনেট ডে স্কুলে রয়েছে ১৬টি বাস। অনেক ছাত্রছাত্রী ওই বাসে করে স্কুলে আসে। স্কুলের চেয়ারম্যান হরেকৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘‘বাসের চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আমরা নিজেদের কাছে রাখি। পুলিশের কাছে জমা করি। প্রতিটি বাসে চালক সহযোগী ছাড়াও একজন মেন্টর থাকেন। তিনি পড়ুয়াদের ওঠানামার বিষয়টি দেখেন।’’ অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে জানতে চাওয়া হয়, বাসে যাতায়াত করতে পড়ুয়াদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা। তাঁরা একটি অ্যাপও চালু করেছেন। যার মাধ্যমে বাড়ি বসে অভিভাবকেরা বাসের অবস্থানের উপরে নজর রাখতে পারছেন। স্কুলগাড়িতে কোথাও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে বলে অবশ্য খোঁজ মিলল না। হরেকৃষ্ণ বলেন, ‘‘শীঘ্রই আমরা বাসগুলিতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা চালু করছি।’’
গোবরডাঙার নিবেদিতা শিশুতীর্থ বিদ্যালয়ের নিজস্ব বাস রয়েছে। পুলকার হিসাবে পরিবহণ দফতর থেকে পারমিট নেওয়া রয়েছে। ২৪ সিটের বাসে অনেকে স্কুলে যাতায়াত করে। তবে কয়েকটি বেসরকারি গাড়ি করেও পড়ুয়ারা আসে। সেই গাড়িগুলি অভিভাকেরাই ঠিক করেন। তবে গাড়িগুলির পুলকার পারমিট নেই। স্কুলের সম্পাদক শান্তনু দে বললেন, ‘‘বেসরকারি গাড়িগুলি যাতে পুলকারের পারমিট নিয়ে পড়ুয়াদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে, তা নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলব।’’ এই স্কুলের এক পড়ুয়ার অভিভাবক বিশ্বজিৎ বিশ্বাস অবশ্য বলেন, ‘‘স্কুলের পুলকার ব্যবস্থায় আমরা খুশি। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা থাকে। ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের বেশি চলবে না। ফলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকি।’’
ইঞ্জিনভ্যান, ব্যাটারিচালিত ভ্যানে কাঠের পাটাতনের উপরে দু’টি বেঞ্চ পাতা। চারদিক ঘেরা। উপরে ফাইবারের ছাউনি। হাবড়া-বনগাঁ শহরে এমন স্কুলগাড়িও দেখা যায়। খুদে স্কুল পড়ুয়াদের ওই সব গাড়িতে করে বিপজ্জনক ভাবে নিয়ে যাওয়া হয়। বছর দু’য়েক আগে এমন স্কুল গাড়ি উল্টে হাবড়ায় ১০ জন পড়ুয়া জখম হয়েছিল। পুলিশ বেআইনি স্কুল গাড়ির বিরুদ্ধে ধরপাকড় করেছিল। সাময়িক বন্ধ হয়েছিল। এখন ফের চলছে।
কিন্তু কেন এমন গাড়িতে ছেলেমেয়েদের স্কুল পাঠাচ্ছেন অভিভাবকেরা?
এক অভিভাবক বলেন, ‘‘এক সঙ্গে অনেকে ভ্যানে করে স্কুলে যায় বলে ভাড়াও কম লাগে। সে জন্য পাঠাই। চালকও সাবধানে গাড়ি চালান।’’ বনগাঁর মাদার টেরিজা অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষক স্বপন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আগে পড়ুয়ারা এ রকম ভ্যান করে স্কুলে আসত। সে সব বন্ধ করে দিয়েছি।’’
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ দফতরের, সরকারি সদস্য গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘বেআইনি স্কুলগাড়ি চলাচল বন্ধ করতে ইতিমধ্যেই জেলা পরিবহণ দফতর থেকে পদক্ষেপ করা হয়েছে। বেসরকারি স্কুলগুলিকে সর্তক করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা যেন পুলকারের অনুমতি নিয়ে পড়ুয়াদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন। জানুয়ারি মাসে বেসরকারি স্কুল থেকে নতুন করে প্রায় ৬০০টি পুলকারের পারমিটের জন্য আমাদের কাছে আবেদন জমা পড়েছে। পর্যায়ক্রমে আমরা জেলায় ১০০ শতাংশ আইনসম্মত স্কুলগাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করছি।’’