অচল: নলকূপ চত্বরে ঘুঁটে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। —ফাইল চিত্র।
উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার ২২টি ব্লকের ২১টিই আর্সেনিকপ্রবণ। তবু আজও ৩০ শতাংশ এলাকায় বাড়ি বাড়ি জলের পাইপলাইপ পৌঁছয়নি। কোথাও কোথাও আবার পাইপ বসানো হলেও তাতে জলের দেখা নেই। ভোটের আগে এলাকায় এসে জল দেওয়ার আশ্বাসবাণীও নেতাদের মুখে গত তিন দশক ধরেই শুনছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয়নি। ফলে, আজওএই সমস্ত এলাকায় জল কিনে খাওয়াটাই দস্তুর।
দেগঙ্গার ২১টি ব্লককে আর্সেনিকপ্রবণ বলে আগেই ঘোষণা করা হয়েছে সরকারি তরফে। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসাবে দেগঙ্গা ছাড়াও বারাসত ১ ও ২ ব্লকের কিছু অংশচিহ্নিত করা হয়েছিল। গত সাত দশক ধরে ওই সমস্ত ব্লকের বহু বাসিন্দার শরীরে মিলেছে আর্সেনিকের ক্ষতচিহ্ন। সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা শতাধিক। বাম আমলে দেগঙ্গার কুণ্ডুপাড়ায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। সে সময়ে নড়েচড়ে বসেছিল প্রশাসন। জেলা পরিষদ সূত্রের খবর, তখন প্রায় ২০০কোটি টাকা বরাদ্দ করে বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছে দেওয়ার পাইপলাইনবসানোর পরিকল্পনা করা হয়।
২০১৪ সালে আর্সেনিক-বিশেষজ্ঞ দামোদর সারেঙ্গির নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল দিল্লি থেকে এসে দেগঙ্গা ঘুরে দেখে। দলের সদস্যেরা কথা বলেন আক্রান্তদের সঙ্গেও। কতগুলি বাড়িতে জল সরবরাহের পাইপ বসেছে, সেই খোঁজও নেন। বিশেষজ্ঞ কমিটির সেই রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করেই জেলাকে আর্সেনিকমুক্তকরতে পদক্ষেপ করে বর্তমান সরকার। দেগঙ্গায় বসানো হয়জলের প্লান্ট।
পাশাপাশি, নদিয়ার চাকদহ এবং নৈহাটি থেকে গঙ্গার জলআনতে পাইপ বসানোর কাজও শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে। জেলা পরিষদ সূত্রের খবর,২০২১ সালের মধ্যে দেগঙ্গা ছাড়াও উত্তর ২৪ পরগনার আর্সেনিকপ্রবণ ব্লকগুলিতে সেই জল সরবরাহের কাজ শেষ করার কথা ছিল।কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আজও পূরণ হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভোটের আগে প্রার্থীরা এলাকায় এসে পরিস্রুত পানীয় জলসরবরাহের প্রতিশ্রুতি আওড়ান। গত বছর কিছু এলাকায় বাড়ি বাড়ি বিনামূল্যে পাইপের সংযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তার পরে কোথাও কিছু দিন জল আসার পরে তাবন্ধ হয়ে গিয়েছে, কোথাও আবার কলে মরচে ধরলেও জলের দেখা মেলেনি। কোথাও আবার গভীর নলকূপ বসানো হলেও সেই জলপানযোগ্য নয়।
দেগঙ্গার বাসিন্দা কুমারেশ সরকার বলেন, ‘‘বাম আমল থেকেই শুনে আসছি, পাইপে জল আসবে। তৃণমূলও এসে একইকথা বলেছে। কিন্তু আজও সব গ্রামে জল পৌঁছয়নি। বন্ধ হওয়া গভীর নলকূপগুলি দিয়ে জল ওঠে না। অনেক বার ঠিককরা হয়েছে। অনেক কলের জলই ব্যবহারের অযোগ্য।’’
আর এক বাসিন্দা আজিবুল হোসেন বলেন, ‘‘যাঁদের টাকা আছে, তাঁরাজল কিনে খাচ্ছেন। সেই জলে কী আছে, তা-ও জানি না আমরা। আর্সেনিক নিয়ে সরকার ভাবে না। বাম-তৃণমূল সকলেই শুধু ভোটের আগে আশ্বাস দিয়েছে। কবে জল পাব, জানি না।’’
প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ২০২০ সালে দেগঙ্গা ছাড়াওবিভিন্ন এলাকার দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা মতো পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প দ্রুত রূপায়ণের নির্দেশ দিয়েছিলজাতীয় পরিবেশ আদালত। বিচারপতি এস পি ওয়াংদি ও বিশেষজ্ঞ সদস্য নাগিন নন্দার বেঞ্চ দ্রুতসেই কাজ শেষ করতে নির্দেশদেয়।
আদালতকে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর জানিয়েছিল, ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পগুলির কাজ শেষকরা হবে। তবে আদালত সেই সময়সীমা আরও কমিয়ে আনার কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তব হল,২০২৩ সালেও দেগঙ্গা ব্লকের সব মৌজায় পরিস্রুত পানীয়জল আসা তো দূর অস্ত্, সর্বত্র এখনও জলের পাইপইবসেনি।
এ বিষয়ে দেগঙ্গার বিধায়ক রহিমা মণ্ডলের যদিও দাবি, ‘‘কাজচলছে। শীঘ্রই সকলের বাড়িতে জল পৌঁছে দেবে সরকার। ইতিমধ্যে বহু গ্রামে জল পৌঁছে গিয়েছে। কিছু মৌজায় এখনও জল আসা বাকি আছে।সেখানে আগামী বছরের মধ্যে জল পৌঁছে যাবে।’’
তবে পাইপলাইন বসানোর কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের একাংশের মতে, এক বছরের মধ্যেবারাসত মহকুমার ব্লকগুলির সব ক’টি বাড়িতে জলের পাইপলাইন পৌঁছে দেওয়ার কাজ রীতিমতো কঠিন।সে ক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এই কাজে হাত লাগাতে হবে।কিন্তু বাস্তবে তা করা হচ্ছে না।