অনুপমের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে উঠে আসছে প্রশ্ন, দ্বিতীয় বার তিনি কাউন্সিলর হওয়ার পরে কি আরও কোনও কিছুতে বড় বাধা হয়ে উঠছিলেন? সেই পথের কাঁটা সরাতেই কি ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে খুন করা হল? আবার এটাও প্রশ্ন, অনুপমকে সরিয়ে দিয়ে আরও অন্য কাউকেও কি কোনও বার্তা দেওয়া হল?
অকুস্থল: এখানেই তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্তকে গুলি করা হয়। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
২০১৮-র এক বৃষ্টির রাত। কারও একটা ফোন পেয়ে একাই এলাকার একটি বন্ধ কারখানায় চলে গিয়েছিলেন পানিহাটির কাউন্সিলর অনুপম দত্ত। অভিযোগ, এক দল দুষ্কৃতী ওই দিন তাঁকে বেধড়ক পিটিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। খবর পেয়ে সতীর্থ এক কাউন্সিলর সেখানে পৌঁছে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান অনুপম। ওই কারখানার জমি পরে বিক্রি হয়ে যায়।
২০১৩ সালে প্রথম কাউন্সিলর হন ছাত্র-রাজনীতি থেকে উঠে আসা, বছর আটত্রিশের ওই যুবক। এ বারও আট নম্বর ওয়ার্ড থেকে জিতেছিলেন। এলাকায় নামডাকও ছিল। কিন্তু রবিবার সন্ধ্যায় একেবারে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁকে মারার পর থেকে একটা বড় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পানিহাটিতে— পুর বোর্ড গঠনের কয়েক দিন আগে এই খুনের নেপথ্যে কারণটা কী? বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও ঘটনার নেপথ্যে প্রোমোটিং-চক্রের হাত থাকার অভিযোগ উঠছে।
সোমবার এ নিয়ে সরব হয়েছেন পানিহাটির তৃণমূল বিধায়ক নির্মল ঘোষও। তাঁর কথায়, ‘‘অনুপম অত্যন্ত একবগ্গা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। জমি-জায়গা দখল করে প্রোমোটিং, তোলাবাজির তীব্র বিরোধিতা করতেন। এলাকা ও পুরসভার স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার মতো কোনও কাজ হলে সবার আগে তার প্রতিবাদ করতেন। তাই কারও ব্যক্তিস্বার্থে ঘা লাগার ফলেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয়।’’ এ দিন একই কথা বলেছেন অনুপমের স্ত্রী মীনাক্ষীও। তিনি বলেন, ‘‘বন্ধ কারখানায় ওঁকে প্রাণে মারার চেষ্টা হয়েছিল। তার পরেও সব বিষয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। সেটা হয়তো কিছু মানুষের পছন্দ ছিল না। নিজেদের আখের গোছাতে তারাই ওঁকে শেষ করে দিল।’’
কামারহাটি ও পানিহাটির একেবারে সীমানায় ওই আট নম্বর ওয়ার্ড। কয়েক বছর আগে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে সেই এলাকাও দেখাশোনা করতেন অনুপম। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ওই কাউন্সিলরের হাতেই ছিল সীমানা এলাকার দায়িত্ব। তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এলাকার জমি-জায়গা বেদখল হওয়ার বিরোধিতা করতে শুরু করেছিলেন অনুপম। এমনকি, কিছু বিষয় দলের শীর্ষ স্তরেও জানিয়েছিলেন। স্থানীয় মহলের অভিযোগ, সাম্প্রতিক কালে এলাকায় বেশ কয়েকটি বন্ধ কারখানার জমি হস্তগত করেছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। যা নিয়ে অনুপমের তীব্র আপত্তি ছিল। বছরখানেক আগে এলাকার একটি বন্ধ কারখানার জমিতে কলেজ তৈরির প্রস্তাব ওঠে। স্থানীয়েরা সেই বিষয়টিকে সমর্থন করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন অনুপমও। তা নিয়েও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল বলে অভিযোগ।
আবার এলাকার একটি পুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশের জমি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তা নিয়েও প্রভাবশালী কারও সঙ্গে অনুপমের ‘ঠান্ডা লড়াই’ শুরু হয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। এ দিন মীনাক্ষীর অভিযোগ, ‘‘ওঁর অনেক শত্রু তৈরি হয়েছিল।’’ প্রশ্ন হল, জমি-জায়গা সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই কি এই শত্রুতা? তা হলে সেই শত্রু কারা? এ দিন আগরপাড়ার খোয়ার রোডের যে হোগলার জঙ্গল থেকে গুলি চালানোয় মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেখানে একটি মাঠও রয়েছে। এ দিন স্থানীয়েরা দাবি করেন, সন্ধ্যা নামলেই ওই জায়গা পুরো অন্ধকারে ডুবে যায়। স্থানীয় দুষ্কৃতী ও বহিরাগতদের আড্ডা বসে। অনেক বার অনুপম এসে তার প্রতিবাদও করেছেন।
অনুপমের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে উঠে আসছে প্রশ্ন, দ্বিতীয় বার তিনি কাউন্সিলর হওয়ার পরে কি আরও কোনও কিছুতে বড় বাধা হয়ে উঠছিলেন? সেই পথের কাঁটা সরাতেই কি ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে খুন করা হল? আবার এটাও প্রশ্ন, অনুপমকে সরিয়ে দিয়ে আরও অন্য কাউকেও কি কোনও বার্তা দেওয়া হল?