মায়ের সঙ্গে মেডেল হাতে পুলক রায়। নিজস্ব চিত্র।
মানসিক প্রতিবন্ধকতায় পড়াশোনা এগোয়নি। তাই আঁকড়ে ধরেন খেলাধুলো। সেই খেলায়
চূড়ান্ত স্তরে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। গ্রিসে অনুষ্ঠিত স্পেশ্যাল অলিম্পিক্স থেকে এনেছেন জোড়া পদক। ভেবেছিলেন, খেলাধুলো হয়তো উপার্জনের রাস্তা খুলে দেবে, মিলবে সরকারি চাকরি। কিন্তু তা হয়নি। অলিম্পিক্সে জোড়া রুপো
জিতেও সরকারি সাহায্য মেলেনি জয়নগরের পুলক রায়ের। বর্তমানে ভাঙাচোরা একটি একতলা ঘরে অশীতিপর মা ও
মানসিক প্রতিবন্ধী দিদির সঙ্গে অভাবের মধ্যে দিন কাটছে বছর চল্লিশের দৌড়বিদের।
জয়নগর-মজিলপুর পুরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডের রায়পাড়ার
বাসিন্দা পুলক। ছোট থেকেই মানসিক বিকাশে সমস্যা রয়েছে তাঁর। দিদিরও একই সমস্যা। ছেলেমেয়ের এই মানসিক অবস্থা দেখে তাঁদের খেলাধুলোয় ব্যস্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেন বাবা-মা। দৌড়ে আগ্রহ ছিল
দু’জনেরই। পাড়ার মাঠে স্থানীয় কোচের কাছে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সেখান থেকে ক্রমশ বড় শহর হয়ে কলকাতার এক ক্লাবে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান তাঁরা। শুরু হয় স্বপ্নের উড়ান। ক্রমশ জেলা ও রাজ্য স্তরে মানসিক প্রতিবন্ধীদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পর পর
সাফল্য পান দুই ভাইবোন। জেতেন প্রচুর পদক। ধীরে ধীরে পুলক জাতীয় স্তরেও নিজেকে প্রমাণ করেন।
জাতীয় স্তরে পর পর সোনা জিতে ২০১১ সালে গ্রিসের আথেন্সে অনুষ্ঠিত মানসিক প্রতিবন্ধীদের স্পেশ্যাল অলিম্পিক্সে যাওয়ার সুযোগ পান। সেই অলিম্পিক্সে ৮০০ মিটার ও ১৫০০ মিটার দৌড়ে রুপো জিতে শেষ করেন তিনি। পুলকের দিদি সিতুল রায় রাজ্য স্তর পর্যন্ত খেলেছেন। তার পরে আর এগোননি।
পুলকের বাবা একটি দোকানে কাজ করতেন। মা গৃহবধূ। সংসারে আর্থিক সমস্যা ছিলই। তা সত্ত্বেও মানসিক ভাবে পিছিয়ে থাকা ছেলেমেয়েকে জয়নগরের বাড়ি থেকে কলকাতায় নিয়মিত প্রশিক্ষণে নিয়ে যেতেন বাবা-মা। ছেলের সাফল্যের পরে তাঁরা ভেবেছিলেন, সুদিন আসবে। কিন্তু তা হয়নি। পুলকের মা দুর্গা জানান, জিতে আসার পরে ক’দিন খুব হইচই হয়। কলকাতায় ডেকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। পাশে থাকার আশ্বাস দেন মন্ত্রী। কিন্তু স্থানীয় পুরসভার তরফে হাজার পাঁচেক টাকা আর্থিক সাহায্য ছাড়া সে ভাবে আর কিছুই মেলেনি। খেলাধুলোয় সাফল্য পেলে চাকরি পাওয়া যায় বলে শুনেছেন তাঁরা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কিছুই হয়নি। ছেলেবেলায় খেলাধুলোর পাশাপাশি আঁকা শিখেছিলেন পুলক। সেই বিদ্যে সম্বল করে পাড়ার দু’-একটি ছেলেমেয়েকে আঁকা শিখিয়ে সামান্য রোজগার করেন এখন।
দুর্গার বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। স্বামী মারা গিয়েছেন। মানসিক প্রতিবন্ধী দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভাঙাচোরা একতলা বাড়িতে থাকেন অসুস্থ বৃদ্ধা। তাঁর আরও তিন
ছেলেমেয়ে আছেন। তাঁরা অন্যত্র থাকেন। তাঁদের আর্থিক সাহায্যেই কোনও মতে চলে সংসার। দুর্গা বলেন, “অনেক আশা নিয়ে ছেলেমেয়েকে খেলাধুলো শিখিয়েছিলাম। টানা ২২ বছর নিয়মিত ওদের নিয়ে
জয়নগর থেকে কলকাতায় গিয়েছি প্রশিক্ষণে। ভেবেছিলাম, খেলাধুলো করে যদি কিছু হয়। ছেলেটা অলিম্পিক্স থেকে জিতে এল। কত হইচই হল। কিন্তু আখেরে কিছুই তো
পেল না। আমি না থাকলে ছেলেমেয়ে দুটোর কী হবে, জানি না। হাজার টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। সরকার তো দুঃস্থ ক্রীড়াবিদদের সাহায্য
করে বলে শুনেছি। সেটাও যদি দেয়, ভবিষ্যতে খেয়েপরে বেঁচে থাকবে।”
পুলক বলেন, “বাবা মারা গেলেন, মা-ও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই কারণে খেলাধুলো আর
এগোয়নি। না হলে হয়তো আরও একটা অলিম্পিক্সে নামতে পারতাম। এখন ছবি আঁকা শেখাই। কোনও রকমে হাতখরচটুকু জোগাড় হয়।
তবে, পাড়ার মাঠে প্র্যাক্টিসটা রোজ করি।”