আইন-বাঁচিয়ে: চলছে দূরত্ব মাপার কাজ। হাবড়ার একটি মণ্ডপে। ছবি: সুজিত দুয়ারি
আদালতের নির্দেশে হয় তো আটকানো যাবে মণ্ডপের ভিতরের গাদাগাদি ভিড়। কিন্তু রায় শোনার পর থেকেই জেলার বড় পুজোর উদ্যোক্তারা অনেকে যে ভাবে মণ্ডপের ১০ মিটার দূরে জায়েন্ট স্ক্রিন বসানোর তোড়জোড় শুরু করেছেন, তাতে আদালতের রায়ের মূল উদ্দেশ্যটাই না ভিড়ে পিষে যায়, সেই জল্পনা শুরু হয়েছে জেলায় জেলায়। তবে কেব্ল টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পুজোর লাইভ টেলিকাস্টের কথা ভাবছেন অনেকে। দর্শককে বাড়ি বসে রাখতে পারলেই এই রায়ের সার্থকতা, মনে করছেন সেই সব পুজোর উদ্যোক্তারা।
সব মিলিয়ে করোনা-আবহে দুর্গাপুজো নিয়ে যে অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা মানছেন সকলেই। জেলার পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের মুখে এখনও কার্যত কুলুপ। মণ্ডপের ভিড় বাইরের জায়েন্ট স্ক্রিনের সামনে হলে সেই ভিড়কে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনও প্রকরণের কথা তাঁরা সোমবার রাত পর্যন্ত অন্তত জানাতে পারেননি। পুজো উদ্যোক্তারাও কেউ কেউ এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছেন। তাঁদের বক্তব্য, হাইকোর্টের রায়কে সম্মান জানিয়ে মণ্ডপের ভিতরে ভিড় ঠেকানোর ব্যবস্থা আমরা সামলে নেব। বাকিটা বুঝুক পুলিশ-প্রশাসন।
বসিরহাট শহরের এক প্রান্তে বড় পুজো উই দ্য গ্রিন ক্লাবের। শহরের অন্য প্রান্তে বরাবর একই রকম ভিড় টানে প্রান্তিক। উই দ্য গ্রিন ক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শাওন সরকার বলেন, ‘‘আদালতের রায় আমাদের মানতেই হবে। তবে আগে থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে হয় তো কোনও সমস্যাই থাকত না। এখন মণ্ডপ ঘিরে ব্যারিকেড করার খরচ বাড়বে।’’ পাশাপাশি তাঁর সংযোজন, ‘‘মনে রাখতে হবে, মানুষের আবেগ কখনও আটকে রাখা যায় না।’’
প্রান্তিক পুজো কমিটির সম্পাদক বাদল মিত্র জানালেন, মণ্ডপের বাইরে নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে জায়েন্ট স্ক্রিন বসানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। বাদলের কথায়, ‘‘আদালতের নির্দেশ মেনেই পুজো হবে। তবে পুজোর আয়োজন প্রায় শেষ। এমন সময়ে এই সিদ্ধান্ত না জানিয়ে প্রথমেই পুজো বন্ধ রাখার কথা বললে ভাল হত।’’
বসিরহাট পুলিশ জেলার সুপার কঙ্করপ্রসাদ বারুই বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দেশনামা হাতে পাইনি। পেলে তা দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ একই কথা জানিয়েছেন বারুইপুর পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন।
ভাঙড়ের শতধারা প্রমিলা সঙ্ঘের পুজো কমিটির সম্পাদক রিনা গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের পুজো যাতে দর্শনার্থীরা বাড়ি বসে দেখতে পারেন, সে জন্য আমরা লাইভ টেলিকাস্টের ব্যবস্থা করেছি।’’
ডায়মন্ড হারবারের অন্যতম বড় পুজো নিউটাউন সর্বজনীন। পুজো কমিটির সদস্য বিশ্বজিৎ নারায়ণ নাগ স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, ‘‘পুজো মণ্ডপ ঘিরে রাখার দায়িত্ব আমাদের। বাকি দায়িত্ব সামলাবে পুলিশ-প্রশাসন।’’ কাকদ্বীপের বড় পুজো পাকাপুল অমৃতায়ন সঙ্ঘের পুজো কমিটির সদস্য দেবব্রত মাইতি জানান, করোনা-আবহে মানুষের মঙ্গলের জন্যই আদালতের এই সিদ্ধান্ত। তাকে মান্যতা দিয়ে দর্শনার্থীদের ভার্চুয়ালে প্রতিমা দর্শন করানোর কথা ভেবেছেন তাঁরা। ক্যানিংয়ের পুজো উদ্যোক্তাদের অনেকে আবার নির্দেশিকার ফাঁকফোঁকর খুঁজে পুজোর আয়োজন করার চেষ্টা করছেন। ক্যানিং মিঠাখালি পাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সম্পাদক পরেশরাম দাস বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী আমাদের পুজো উদ্বোধন করেছেন। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশিকা আমরা মেনে চলব। মণ্ডপের মধ্যে দর্শনার্থীদের প্রবেশ করার অনুমতি না থাকলেও মণ্ডপের বাইরে জায়েন্ট স্ক্রিনের মাধ্যমে প্রতিমা ও মণ্ডপসজ্জা দর্শনার্থীদের কাছে তুলে ধরা হবে।’’ কিন্তু সেখানে ভিড়, গাদাগাদি হলে তার দায় কে নেবে? পরেশ জানান, স্বাস্থ্যবিধি যাতে বজায় থাকে, তার ব্যবস্থা করা হবে। বনগাঁ শহরের এ বার বিগ বাজেটের পুজো শিমুলতলা অধিবাসীবৃন্দ। পুজো কমিটির পক্ষে শঙ্কর আঢ্য জানান, মণ্ডপের বাইরে জায়েন্ট স্ক্রিন বসানো হবে। গোবরডাঙার গড়পাড়া বিধানস্মৃতি সঙ্ঘের তরফে শঙ্কর দত্ত জানান, আদালতের নির্দেশ মেনেই চলবেন তাঁরা। পুজোর ভিডিয়ো ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
দুই জেলার সচেতন বহু মানুষেরই বক্তব্য, হাইকোর্ট এই রায়ে যে বার্তা দিতে চেয়েছে, সেটাই সকলের বোঝা দরকার। ভিড় না এড়়ালে পুজোর পরে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকার নিতে পারে। এরপরেও যদি মানুষ দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন আর পুজো উদ্যোক্তারা ১০ মিটারের দূরত্ববিধি মেনে জায়েন্ট স্ক্রিনের সামনে ভিড় টানার তোড়জোড় করেন, সেটা নেহাতই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে।
অনেকের মতে, আদালতের রায়ের পরে এ বার কড়া হাতে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করুক পুলিশ। দরকার হলে পুজোর দিনগুলিতে আগের মতো লকডাউন ঘোষণা করে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হোক। বনগাঁর এক প্রবীণের কথায়, ‘‘পুজোয় ভিড় আটকাতে এখন শাসক দলের কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও থাকল না। সে ক্ষেত্রে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত মতো ভিড় আটকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করুক সরকার।