এই পরিস্থিতিতেই দিন কাটাচ্ছেন বহু মানুষ। —নিজস্ব চিত্র।
প্লাস্টিকের ছাউনি ঘেরা গোয়াল ঘরের ভিতর থেকে গরুর ডাক ভেসে আসছিল। কাছে গিয়ে দেখা গেল, গরুর গা ঘেঁষে বিছানা পাতা। বাড়ির দু’এক জন আড়মোড়া ভাঙছেন সেখানেই। দুর্গন্ধে ভরা।
এ ভাবেই বছরের পর বছর বসবাস করছে পরিবারটি। এ চিত্র কোন পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রামের নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বহু পুরনো জয়নগর-মজিলপুর পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিমপাড়ার। বস্তি উন্নয়ন নিয়ে পুরভোটের মুখে প্রচারের হাতিয়ার করেছে সব বিরোধী দল। তবে পাল্টা জবাব দিতে অপ্রচারের যুক্তি খাঁড়া করে প্রচারে নেমেছে বিদায়ী তৃণমূল ও এসইউসি।
জয়নগর-মজিলপুর পুরসভা সরকারি পর্যায় অনুযায়ী ‘ই’ ক্যাটাগরির। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এলাকার জনসংখ্যা এবং উন্নয়নের নিরিখে ওই পুরসভা একেবারেই পিছিয়ে। গড়ে ওঠেনি কোনও কলকারখানা বা শিল্পাঞ্চল। ১৪৬ বছরের পুরনো পুরসভায় ১৪টি ওয়ার্ডে প্রায় সব জায়গাতেই বস্তি এলাকা রয়ে গিয়েছে। তারমধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোষের বাগান মুসলমান পাড়া, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের হাসানপুর, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিমপাড়া, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের খাঁ পাড়া, ঢালিপাড়া ছাড়াও বাকি ওয়ার্ডগুলিতে কিছু কিছু বস্তি এলাকা রয়েছে। বস্তিবাসীদের অভিযোগ, নতুন ঘর পাওয়া তো দূরের কথা, পুরসভার সাধারণ পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা। বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিকাশি খাল বন্ধ করে অবৈধ ভাবে বাড়ি, দোকানঘর তৈরি হওয়ায় জল নিকাশি পথ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষায় জলাশয় ভরে গিয়ে রাস্তার উপর জল থৈ থৈ করে। তা ছাড়া, নিকাশি নালা সংস্কারের অভাবে জমা জল পচে গিয়ে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়ায়। মশা মাছির উপদ্রবে দিনের বেলাতেও মশারি খাটিয়ে থাকতে হয়। এলাকার আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট কোনও ভ্যাট নেই। ফাঁকা জায়গায় জঞ্জাল ফেলতে ফেলতে সেটাই ভ্যাটের চেহারা নেয়। নিকাশি নালাগুলিতে কবে শেষ ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হয়েছে, তা মনে করতে পারলেন না অনেকেই। তবে এ সব সমস্যার পাশাপাশি বস্তি উন্নয়ন নিয়ে ক্ষোভ বিস্তর।
বহু বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। বিদায়ী বোর্ড তৃণমূল ও এসইউসি জোটের। বস্তি উন্নয়ন নিয়ে তাদের মধ্যে চাপানউতোর আছে।
বস্তি উন্নয়নের কাজ কতটা হয়েছে তা দেখতে ঘুরে আসা গেল ১ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিমপাড়ায়। ওই ওয়ার্ডটিতে গত বারে নির্বাচনে নির্দল হয়ে জয়ী হন ফরিদা বেগম শেখ। পরে যোগ দেন তৃণমূলে। পুরপ্রধানও হন তিনি। এ বারেও ওই ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী ফরিদা। তাঁর মূল প্রতিযোগী ৬ বারের পুরপ্রধান হওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কংগ্রেসের প্রশান্ত সরখেল। ৭৭ বছর বয়সী এই নেতা এ বারও পুরপ্রধান হওয়ার দাবিদার। তাঁর বাড়ি ১১ ওয়ার্ডে হলেও ওই ওয়ার্ডে কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়িয়েছেন প্রশান্তবাবুর ভাইপো সুজিত সরখেল। তাই প্রাক্তন ও বিদায়ী দুই পুর প্রধানের ভোটের ময়দানে লড়াই জমে উঠেছে। জয়ের ব্যাপারে দু’জনেই আশাবাদী।
ওই ওয়ার্ডে ঢুকে পৌঁছনো গেল দিনমজুর হচেন মণ্ডলের বাড়িতে। বাড়ি না বলাই ভাল। ত্রিপলে ঢাকা গোয়াল ঘর ও একটি খুঁড়ে ঘর। গোয়াল ঘরের একধারে লাল রঙের গরুটা ‘হাম্মা হাম্মা’ করে ডেকেই চলেছে। ফুট দশেক দূরে বিছানা পাতা। মানুষ ও গরু একই ঘরে সহাবস্থান। গোয়াল ঘরের সামনে ১০ ফুট বাই ১৫ ফুটের দরমার ভাঙাচোরা দেওয়ালে পলিথিনে ঢাকা একটি কুঁড়ে ঘর। যে কোনও সময়ে দমকা হাওয়ায় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। ওই ভাবেই ৪ ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধা মাকে নিয়ে থাকেন মণ্ডল দম্পতি। নতুন ঘর করার আবেদন নিয়ে পুরসভায় গিয়েছেন একাধিকবার। হচেনের দাবি, ‘‘যত বার গিয়েছি, আশ্বাস নিয়ে ফিরতে হয়েছে। আজ পর্যন্ত ঘর তৈরির টাকা পেলাম না। এ ভাবেই বেঁচে আছি। বর্ষার দিনগুলোতে বড্ড কষ্ট।’’
৬ নম্বর ওয়ার্ডের হাসানপুরে জয়নাপ বেওয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, দরমার দেওয়ালে পলিথিন ঢাকা ছোট একটা কুঁড়ে ঘর। দেওয়ালের মাটি খসে পড়েছে। বিবর্ণ ত্রিপলি। কোনও মতে মাথা গোঁজা। জয়নাপ বললেন, ‘‘এই পাড়ার কাউন্সিলরকে আমার বাড়িটি করে দেওয়ার জন্য একাধিক বার বলেছি। কিন্তু কে কার কথা শোনে।’’ তিনি বলে চলেন, ‘‘রাতে বৃষ্টি নামলে কিশোরী মেয়েটাকে নিয়ে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে এখানে ওখানে ছুটতে হয়।
বস্তিবাসীদের প্রশ্ন, পুরসভা থেকে ঘর পেতে গেলে অগ্রিম ১৬ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। ওই টাকা আমাদের অনেকের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। ফলে আমরা কি এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাব না?’’
বস্তি উন্নয়ন ছাড়াও রাস্তাঘাট-নিকাশি নালা সংস্কার নিয়ে কংগ্রেসের প্রাক্তন পুরপ্রধান প্রশান্ত সরখেল বলেন, ‘‘আমি ২০১০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময়ে বস্তি ও রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য ৪ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা অনুমোদন হয়েছিল। ওই টাকা দিয়ে কিছু কাজ করা হয়েছিল। তৃণমূল ও এসইউসি জোটের বোর্ড ক্ষমতার আসার পরে বস্তি উন্নয়নের জন্য সরকার কোনও টাকা অনুমোদন করেনি। ফলে এই বোর্ড উন্নয়নে একেবারে পিছিয়ে দিয়েছে।
বিদায়ী পুরপ্রধান ফরিদা বেগম শেখ আবার বলেন, ‘‘বিগত বোর্ডে অনুমোদনের টাকা দিয়ে ১১০টি বাড়ি করার পরে বাকি টাকা দিয়ে আরও ১১৫টি বাড়ি-রাস্তাঘাট সংস্কার করেছি। তা ছাড়া, নিয়ম অনুযায়ী পরিকাঠামো ও গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ১ লক্ষ করে টাকা উপভোক্তারা ১৬ হাজার টাকা জমা দিলে তবেই পাবেন। এ ক্ষেত্রে অনেক গরিব পরিবার ওই টাকা জমা করতে না পারায় সমস্যা হয়েছিল। সেটা সমাধান করা হয়েছে।’’ তিনি আরও জানান, পুরসভায় ক্ষমতায় আসার পরে বস্তি উন্নয়নের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা পেয়েছি। ১ কোটি ৪৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৩৩টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৬০টি বাড়ি নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পথে। ২৪টি বাড়ি অনুমোদন হলেও এখনও টাকা পাওয়া যায়নি। এমনকী, আরও ১০০টি বাড়ি নির্মাণের জন্য তালিকা পাঠানো হয়েছে। গত ৫ বছরে রাস্তা ও নিকাশি নালা সংস্কার ও নির্মাণের জন্য ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত ২ কোটি ২২ লক্ষ টাকার কাজ হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
দু’পক্ষের এই তথ্য-পরিসংখ্যানটুকু শোনা ছাড়া অবশ্য অন্য উপায় নেই হচেন-জয়নাপদের।