কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন কৃষ্ণেন্দু (ডানদিকে)। নিজস্ব চিত্র।
আদিবাসী শিশুদের স্কুলছুট হওয়া আটকে কয়েক বছর আগে তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। তখন তিনি পূর্ব বর্ধমানে স্কুল পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। এ বার দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর উত্তর চক্রে একই পদে থেকে প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন করে এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি করে ফের জাতীয় পুরস্কার জিতলেন এ তল্লাটের ‘প্যাডম্যান’ হয়ে ওঠা কৃষ্ণেন্দু ঘোষ।
সম্প্রতি দিল্লির অম্বেডকর আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে কৃষ্ণেন্দুর হাতে ওই পুরস্কার তুলে দেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। কৃষ্ণেন্দু বলেন, “পুরস্কার পেতে পারি ভাবিনি। তবে, যে কোনও সম্মানই উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। আরও বেশি করে ছাত্র-ছাত্রীদের উপকারে কাজ করে যেতে চাই। ভবিষ্যতে জেলার অন্য এলাকাতেও এই কাজ ছড়িয়ে দেওয়া আমার লক্ষ্য।”
অক্ষয়কুমার অভিনীত ‘প্যাডম্যান’ চলচ্চিত্রে অক্ষয়ের চরিত্রটি স্ত্রীর ঋতুকালীন কষ্ট দূর করতে ঘরোয়া উপায়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করতে উদ্যোগী হন। পরে সেই ন্যাপকিন গ্রামের মহিলাদের মধ্যে বিলি করা শুরু করেন। অনেকটা সেই রকম ভাবেই স্কুল পরিদর্শক হিসেবে কাজ করতে গিয়েই গ্রামীণ এলাকায় ছাত্রীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যের নানা সমস্যা প্রত্যক্ষ করেন কৃষ্ণেন্দু। সিদ্ধান্ত নেন, নিজের কাজের পাশাপাশি নজর দেবেন স্কুলের ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে। সেই মতো ছাত্রীদের হাতে নিয়মিত স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। সেই সঙ্গে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতেও উদ্যোগী হন তিনি। সেই কাজেরই স্বীকৃতি মিলল জাতীয় স্তরে।
তিনি জানান, তাঁর কাজ প্রথমে জেলা, পরে রাজ্য স্তরে স্বীকৃতি পায়। তারপরেই বিবেচিত হয় জাতীয় পুরস্কারের জন্য। এ বার এই পুরস্কারের জন্য গোটা দেশ থেকে তিন হাজারেরও বেশি আবেদন জমা পড়েছিল বলে জানান তিনি। এ রাজ্য থেকে ছ’জনকে বাছাই করে দিল্লি ডাকা হয়েছিল। তার মধ্যে থেকে পুরস্কার জেতেন কৃষ্ণেন্দু।
স্কুল ছাত্রীদের নিয়ে কৃষ্ণেন্দুর কাজ শুরু হয় ২০১৮ সাল নাগাদ। তার কিছুদিন আগেই জয়নগর উত্তর চক্রের স্কুল পরিদর্শক হয়ে আসেন তিনি। কিছুদিন কুলতলি চক্রের স্কুল পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্বও সামলাতে হয়েছিল তাঁকে। কৃষ্ণেন্দু জানান, প্রত্যন্ত গ্রামীণ এইসব এলাকায় কাজ করতে গিয়ে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে ছাত্রীদের দুর্দশার ছবিটা সামনে থেকে দেখেন তিনি। স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার জানতেন না অনেকেই। জানলেও আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের মেয়েদের কাছে তা ব্যবহার করার তেমন সুযোগ ছিল না। সংক্রমণ-সহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হত। মাসের নির্দিষ্ট সময় স্কুলে আসত না অনেকেই। ক্ষতি হত পড়াশোনায়। ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতাও ছিল না এলাকায়। নানা কুসংস্কার ঘিরে ছিল।
এ সবের বিরুদ্ধেই লড়াই শুরু করেন কৃষ্ণেন্দু। প্রথমেই স্কুল ধরে ধরে ছাত্রীদের হাতে তুলে দেন স্যানিটারি ন্যাপকিন। কৃষ্ণেন্দুর দাবি, কয়েক বছর ধরে এলাকার প্রায় ২৫টি স্কুলের হাজারেরও বেশি ছাত্রীকে কয়েক হাজার স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যেই লকডাউনে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে স্কুলের ছাত্রীদের ন্যাপকিন বিলি করেছেন কৃষ্ণেন্দু। সেই সময় ছাত্রীদের পাশাপাশি বাড়ির অন্য মহিলাদের জন্যেও স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হয়। পাশাপাশি ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজও চালিয়ে গিয়েছেন লাগাতার। এখনও কৃষ্ণেন্দুর উদ্যোগে স্কুলে এবং স্কুলের বাইরে নিয়মিত সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। নিয়মিত বিলি করা হচ্ছে স্যানিটারি ন্যাপকিনও।
জাতীয় পুরস্কার কাজের উৎসাহ বাড়াবে বলেই মনে করেন কৃষ্ণেন্দু।