—প্রতীকী চিত্র।
লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত— একের পর ভোট আসে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সীমান্ত লাগোয়া ব্লক বাগদার মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ভোটের লাইনে দাঁড়ান। যে কোনও ভোটের প্রচার-পর্বে রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে পান প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। কিন্তু ভোট মিটে গেলে সে সব প্রতিশ্রুতির কথা কেউ মনে রাখেন বলে অভিযোগ। এ বারের উপ নির্বাচনের আগেও বাগদাবাসী প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভেসে যাচ্ছেন।
বাগদা ব্লকের অনেক মানুষই নিজেদের কার্যত ‘নেই রাজ্যের’ বাসিন্দা মনে করেন। এলাকার পরিকাঠামোর উন্নয়ন সেই তিমিরেই। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, বাগদা ব্লকের জন সংখ্যা ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৯৭৪ জন। আয়তন ৯০.১৪ বর্গ মাইল। এই ব্লকে কোনও দমকল স্টেশন নেই। কোথাও আগুন লাগলে বনগাঁ শহর থেকে দমকলের ইঞ্জিন পৌঁছতে পৌঁছতেই সব পুড়ে ছাই হয়ে যায় বলে অভিযোগ। আগুনে পুড়ে মানুষের মৃত্যুও ঘটেছে আগে। দাহ করার জন্য বৈদ্যুতিক চুল্লি নেই। যে সব শ্মশান আছে, তার পরিকাঠামো বেহাল বলে অভিযোগ। ফলে এখানকার অনেক মানুষই প্রিয়জনের মৃত্যু হলে নদিয়ার নবদ্বীপ, হালিশহর, বনগাঁ শহরে দেহ নিয়ে আসেন। দূরে শবদাহ করতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে গত কয়েক বছরে। প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি আষাঢ়ু পঞ্চায়েত এলাকায় কোদালিয়ার নদীর পাশে বৈদ্যুতিক চুল্লির কাজ শুরু হয়েছে।
বাগদা ব্লকের চিকিৎসার প্রধান ভরসা বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতাল। বাগদা ব্লকের এক মাত্র হাসপাতাল এটি। অভিযোগ, এখানেও পরিকাঠামো বেহাল। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, আলট্রা সনোগ্রাফ্রি হয় না। এক্স-রে আগে হলেও এখন বন্ধ। হাসপাতালে শয্যা-সংখ্যা সরকারি ভাবে ৩০টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলতে আছেন এক জন শিশু বিশেষজ্ঞ এবং দু’জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। কিছু দিন আগে হাসপাতালে সিজ়ার চালু হয়েছিল। বিদ্যুতের সমস্যায় এখন তা বন্ধ।
বাগদা ব্লকে তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। অভিযোগ, সপ্তাহে তিন-চার দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য বহির্বিভাগে চিকিৎসক থাকেন। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অনেক বছর আগে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা ছিল। ২৪ ঘণ্টা নার্স-চিকিৎসক থাকতেন। গ্রামের মানুষের দাবি, আবার রোগী ভর্তির ব্যবস্থা চালু করুক সরকার। ২৪ ঘণ্টা যেন চিকিৎসক থাকেন।
আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের সমস্যা আজও মেটেনি। পাইপ লাইনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছয়নি সর্বত্র। ব্লকের অনেক মানুষই পানীয় জল কিনে খান। এই সুযোগে বেআইনি পানীয় জলের কারবার গজিয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে সজল ধারা প্রকল্প আছে। গভীর নলকূপ থাকলেও তার জল আর্সেনিক মুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হয় না বলে অভিযোগ।
কৃষিপ্রধান এলাকা বাগদা। অথচ, এখানে কৃষিভিত্তিক কোনও শিল্প গড়ে তোলা যায়নি। আনাজ, ফসল সংরক্ষণের জন্য সরকারি কোনও আধুনিক হিমঘর নেই। চাষিরা জানালেন, ফড়েদের জন্য তাঁরা ফসলের প্রকৃত মূল্য পান না। তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই আনাজ ফড়েদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন চাষি। রয়েছে সেচের সমস্যা।
ইছামতী, কোদালিয়া, বেতনা, কপোতাক্ষ নদীগুলি সংস্কারের অভাবে মৃতপ্রায়। জলপথে পরিবহণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মৎস্যজীবীরা কাজ হারিয়ে দিনমজুরি, খেতমজুরি বেছে নিয়েছেন। অভিযোগ, নদীর জমি দখল করে নির্মাণ কাজ চললেও প্রশাসন নির্বিকার। নদী দখল করে বেআইনি ভাবে মাছ চাষ হচ্ছে। নদীর মাটি বেআইনি ভাবে তুলে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। জলাভূমি ভরাটের অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে।
রয়েছে যানজটের সমস্যা। হাটবারে হেলেঞ্চা এবং বাগদায় ব্যাপক যানজট হয় বনগাঁ-বাগদা সড়কে। অভিযোগ, বাজারগুলির পরিকাঠামো বেহাল। এলাকায় কাজ না থাকায় বহু মানুষ ভিন্ রাজ্যে বা বিদেশে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে গিয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান, পাচার নিত্য দিনের ঘটনা।
বাগদা থেকে কলকাতায় যাওয়ায় সরাসরি বাস নেই। নেই রেলপথ। যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত কিছুই নেই। বাগদায় বেশ কয়েকটি সেতুর দাবি মানুষের দীর্ঘ দিনের। আজও তার সুরাহা হয়নি।
বাগদার অনুন্নয়ন নিয়ে বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডল বলেন, ‘‘গত ১৩ বছরে তৃণমূল বাগদার কোনও উন্নয়ন করেনি। উপ নির্বাচনের আগে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা পরিযায়ী পাখির মতো এখানে এসে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। বাগদার মানুষ এটাও জানেন, ভোট শেষ হয়ে গেলে এঁদের আর দেখা মিলবে না।’’
বাগদার বাম প্রার্থী, ফরওয়ার্ড ব্লকের গৌর বিশ্বাস বলেন, ‘‘১৩ বছর একটা দীর্ঘ সময়। এই সময়ে বাগদার সার্বিক উন্নয়ন করতে না পারাটা তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতা।’’
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে বাগদার প্রাক্তন বিধায়ক তথা তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘বাগদায় বৈদ্যুতিক চুল্লির কাজ শুরু হয়েছে। দমকল স্টেশন তৈরির জন্য জমি চিহ্নিত হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অনুমোদন হয়েছে। ৮০ কোটি টাকার রাস্তা তৈরি হয়েছে। বাগদায় যে ক’টি সেতুর দাবি আছে, তা-ও ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে তৈরি করে দেওয়া হবে।’’