বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছেন প্রভাতী (ব্যাগ কাঁধে)। বাঁ দিকে, প্লাস্টিক সংগ্রহ করা হচ্ছে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
কখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছেন। আবার কখনও পাড়ায় পাড়ায় বৈঠক করেন তিনি। বাগদার প্রভাতী বিশ্বাসের উদ্দেশ্য প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা।
বাগদায় বাপের বাড়ি প্রভাতীর। তিনিই কয়েকজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেছেন একটি দল। তাঁর দলই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছেন সবাইকে। প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে গ্রামে জ্বর-ডেঙ্গি- ম্যালারিয়া ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা থেকে মুক্তি পেতে প্রথমে প্লাস্টিক বর্জন করতে হবে বলে মনে করেন প্রভাতী। তাই তাঁর এই উদ্যোগ।
গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই প্লাস্টিকের ব্যবহার দেখা যায়। কোনও বাড়ির উঠোনে, কলপাড়ে বা বাড়ির চারিপাশে প্লাস্টিক পড়ে থাকে। প্রভাতীরা বাড়িতে ঢুকে তাঁদের কাছ থেকে বস্তা চেয়ে নিয়ে নিজেরাই সেই সব প্লাস্টিক কুড়িয়ে বস্তাবন্দি করছেন।
দু’বছর ধরে প্রভাতীর লাগাতার চেষ্টায় বাগদা ব্লকের সিন্দ্রাণী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দারা প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে সচেতন হয়েছেন। বেশির ভাগ বাড়িতে এখন আর প্লাস্টিক যত্রতত্র পড়ে থাকে না। আর এ সবের ফলে এলাকায় পতঙ্গবাহিত রোগের প্রকোপও কমেছে। এ জন্য প্রভাতীকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন প্রশাসনের কর্তারা।
প্রভাতীর বিয়ে হয়েছে নদিয়ার ধানতলা থানার শঙ্করপুরে। সিন্দ্রাণী এলাকায় হেলথ সুপারভাইজার হিসাবে কাজ করেন বছর আটান্নর ওই মহিলা। পেশাগত কারণে তাঁকে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয়। মানুষের শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখতে হয়। সেই সূত্রে আগের থেকেই গ্রামের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই পরিচিতি তিনি কাজে লাগিয়ে প্লাস্টিকমুক্ত পঞ্চায়েত গড়ার কাজ করে চলেছেন। প্লাস্টিক নিয়ে কাজ করাটা তাঁর পেশাগত ডিউটির মধ্যে পড়ে না। এলাকার মানুষের মধ্যে শৌচাগার ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজও তিনি করেছেন। সফলও হয়েছেন।
প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে কাজকর্ম কী ভাবে শুরু হয়েছিল প্রভাতীর?
বছর দু’য়েক আগে সিন্দ্রাণী-সহ বাগদা ব্লকে জ্বর-ডেঙ্গির প্রকোপ ছড়ায়। প্রশাসনের কর্তরা কারণ অনুসন্ধান করে বুঝতে পারেন জ্বর-ডেঙ্গির প্রকোপের অন্যতম কারণ প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। কী ভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে অলোচনা করতে প্রশাসনিক বৈঠকে বসেন কর্তারা। সেখানে নিজে থেকে হাজির হয়ে প্রভাতী জানান, তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি মানুষকে সচেতন করতে পারবেন। প্রশাসনের কর্তারা প্রভাতীর উপর ভরসা রাখেন। শুরু হয় কাজ। প্রভাতী বেছে নেন একটি বড় গ্রাম, পাথুরিয়া। আশাকর্মী, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা, আইসিডিএস, এনএমএস-সহ সমস্ত সরকারি প্রকল্পে কাজ করা মহিলাদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে প্লাস্টিকের ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে বোঝানো শুরু করেন তিনি। সেই সঙ্গে নিজেরা প্লাস্টিক কুড়োতে থাকেন।
এক বাড়িতে তিনি বেশ কয়েকবার গিয়েছেন। এখনও যাচ্ছেন। এখনও পর্যন্ত তিনি সিন্দ্রাণী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় ৯ হাজার বাড়িতে গিয়ে সচেতনার কাজ করেছেন। প্লাস্টিকে জল জমে ডেঙ্গি মশার লার্ভা জন্মায়। সেটাও তিনি হাতে কলমে মানুষকে দেখিয়ে দিচ্ছেন। মানুষ ডেঙ্গির লার্ভাও চিনতে শিখেছে। এখন আর গ্রামবাসী ঘরের বাইরে প্লাস্টিক ফেলে রাখেন না। বস্তাবন্দি করে রাখেন। সরকারি গাড়ি গিয়ে সেই প্লাস্টিক সংগ্রহ করে আনে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সিন্দ্রাণী পঞ্চায়েত এলাকাকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে এলাকায় সলিডওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা প্লাস্টিক প্ল্যান্টে এনে তা দিয়ে ইকো-ইট তৈরি করা হচ্ছে। বাগদা ব্লকের স্যানেটারি সুপারভাইজার নির্মল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গ্রামের মানুষের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার না করা নিয়ে সচেতনার ভিতটা তৈরি করে দিয়েছেন প্রভাতীরা।’’
বনগাঁর মহকুমাশাসক কাকলি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সিন্দ্রাণী এলাকায় এখন জ্বর-ডেঙ্গির প্রকোপ কমেছে অনেকটাই। উল্লেখযোগ্য ভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমেছে। মানুষ সচেতন হয়েছেন, এ সব সম্ভব হয়েছে প্রভাতীর কাজের জন্য। ওঁনার মধ্যে মানুষকে বোঝানোর বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। নিজের পেশার বাইরে এমন কাজ সত্যিই প্রশংসনীয়।’’ কিছুদিন পরে প্রভাতী অবসর নেবেন। এখনও উনি প্রবল উৎসাহে কাজ করছেন। ওনাকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য পঞ্চায়েত দফতরের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। প্রভাতীর কথায়, ‘‘মানুষ সচেতন হয়েছেন এটা দেখেই আনন্দ হয়। এ ভাবেই কাজ করে যেতে চাই। গোটা বাগদা ব্লক প্লাস্টিকমুক্ত হয়েছে এমনই স্বপ্ন দেখি।’’