বাসন্তীতে জলে পড়ে যাওয়া এক শিশুকে তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সময়মতো চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ায় বেঁচে যায় শিশুটি। নিজস্ব চিত্র।
সকালবেলা বাড়ির উঠোনে খেলছিল বছর আড়াইয়ের ফুটফুটে দুই শিশু। মা, কাকিমারা ব্যস্ত ছিলেন গৃহস্থালির কাজে। কখন বাড়ির পাশের পুকুর ধারে চলে গিয়েছিল দুই শিশু, খেয়াল করেননি কেউ। বেশ কিছুক্ষণ দু’জনের কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে টনক নড়ে বাড়ির লোকের। চারদিকে খোঁজ শুরু হয়। ঘণ্টাখানেক পর পুকুরের জলে ভেসে ওঠে দুই শিশুর দেহ। কুলতলির পশ্চিম জামতলা গ্রামের ঘটনা। দুই ভাই শম্ভু ও ধনঞ্জয়ের দুই ছেলেমেয়ের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নামে গ্রামে।
গত এক বছরে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন ঘেঁষা এলাকায় এভাবেই জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ৩৩৮ জন শিশুর। সম্প্রতি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় উঠে এসেছে এই তথ্য। সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান সংস্থার আধিকারিকেরা।
দিন কয়েক আগে মৃত্যু হয় গোসাবার রাধানগর গ্রামের সামসুদ্দিন মোল্লার বছর পাঁচেকের মেয়ে ও চার বছরের ভাগ্নির। খেলতে খেলতে বাড়ির পাশের একটি পুকুরে পড়ে যায় সামসুদ্দিনের মেয়ে। দিদিকে বাঁচাতে পুকুরে নামতে গিয়ে তলিয়ে যায় আরও এক শিশু। পরে যখন পুকুর থেকে দুই বোনের দেহ উদ্ধার হয়, দেখা যায় একে অপরের হাত আঁকড়ে
ধরে আছে। কুলতলির কামারের চকের নরেশ নস্করের সাড়ে চার বছরের ছেলেও খেলতে খেলতে পড়ে যায় পুকুরে। জলে নেমে খুঁজতেই উদ্ধার হয় শিশুটির নিথর দেহ। মণ্ডলের হাটে শুকদেব নস্করের জলে ডুবে মৃত ছেলের বয়স আরও কম। মাত্র বছর দেড়েক। সকালবেলা উঠোনে খেলতে খলতে মা-ঠাকুমার চোখ এড়িয়ে পাশের ডোবায় পড়ে যায় সে। এরপরেই মেলে দেহ।
শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ওই সংস্থা সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে জলে ডুবে শিশুর মারা যাওয়া নিয়ে। প্রাথমিক ভাবে সুন্দরবন ও লাগোয়া উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ১৯টি ব্লকের গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই ভাবে মৃত শিশুদের পরিসংখ্যান সংগ্রহ চলছে। তার ভিত্তিতে চেষ্টা চলছে কোন পথে এই ধরনের মৃত্যু ঠেকানো যায়। সংস্থার দাবি, এই ধরনের বিষয় নিয়ে দেশের মধ্যে এই প্রথম কাজ হচ্ছে।
সংস্থার তরফে প্রকল্পের সঞ্চালক সুজয় রায় বলেন, ‘‘শিশুদের নানা মারণ রোগ নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর প্রচার অভিযান চালায়। শিশুমৃত্যুর বিভিন্ন কারণ নিয়ে সচেতন করা হয়। তবে এই দিকটা বরাবর উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে। কিন্তু গ্রামে গ্রামে ছবিটা মারাত্মক। এখনও পর্যন্ত যে যে এলাকায় সমীক্ষা হয়েছে, সেখানে গত তিন বছরে দশ বছরের কম বয়সী শিশুর ৬৯ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে জলে ডুবে।’’ কিন্তু পঞ্চায়েত বা সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের রেকর্ডে এত শিশু মৃত্যুর উল্লেখই নেই। এই মৃত্যু রদে তেমন কোনও সচেতনতামূলক কর্মসূচিও তারা করে না। সরকারি রেকর্ড যে নেই, তা স্বীকার করে নেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সিএমওএইচ সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরনের ঘটনার পর বাড়ির লোক শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনেন না। ফলে কোনও রেকর্ডও থাকে না। তবে ঘটনা যে ঘটছে, এটা সত্যি। সেদিক থেকে ওই সংস্থা যে কাজটি করছে, তা প্রশংসাযোগ্য।’’বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা একদমই নেই। ওই সংস্থার এক ফিল্ড কর্মীর কথায়, ‘‘উদ্ধারের পর প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই শিশুটিকে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়নি। কোথাও গুনিন ডাকা হয়েছে। আবার কোথাও নানা তুকতাক করা হয়েছে।’’ শেষ পর্যন্ত কাজ না হওয়ায় মাটিতে পুঁতে বা জলে ভাসিয়ে সৎকার করা হয়েছে দেহ। অথচ এমন অনেক ঘটনাই আছে, যেখানে উদ্ধারের পর দ্রুত চিকিৎসা হলে হয়ত শিশুটি বেঁচে যেত বলে তিনি জানান।
সুজয় জানান, প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাড়ির ভেতরে থাকা ছোট ডোবা বা জলাশয়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তাই বাড়ির কাছাকাছি ডোবা বা পুকুর ঘিরে রাখলে ভাল। তা ছাড়া ঘটনা ঘটলে যাতে দেরি না করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়, সে ব্যাপারে সচেতন করা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামে আশা কর্মীদের যদি এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করা যায়, তা হলে তাঁরা দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসাটা দিতে পারবেন। বিদেশের ধাঁচে একেবারে ছোট বয়সে শিশুদের সাঁতার শেখানো হলেও দুর্ঘটনা আটকানো সম্ভব।’’