গাছ উপড়ে পড়েছে আমডাঙায়। ছবি: সুদীপ ঘোষ
নদী ঘেরা সুন্দরবনে পেশাগত প্রয়োজনে নৌকো, ভুটভুটিতে হামেশাই উঠতে হয়। কিন্তু বুধবার সকাল থেকেই গোসাবায় বিদ্যাধরী ফুলেফেঁপে উঠে এমন চেহারা হয়েছিল, দেখে বুক কেঁপে উঠল। তখন অপেক্ষা করছি, কখন আছড়ে পড়বে আমপান।
বেলা ১২টার পরে আর নদীর পাড়ে থাকার সাহস হল না। জোরে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বুঝলাম, ‘সে’ আসছে। ফিরে এলাম গেস্ট হাউসের ঘরে।
বিকেল ৪টের পরে শুরু হল গোঁ গোঁ শব্দ। প্রকৃতি উথালপাথাল। সব যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। নদীর ঘন ঘন ছলাৎ শব্দে কিসের যেন অশনিসঙ্কেত। গেস্ট হাউসের কর্মীরা দেখলাম ছোটাছুটি করছেন। বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে রাখছেন। যদি এক মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বেরিয়ে আসতে হয় বাইরে!
ঝড় শুরুর আগেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল গোটা এলাকা। গেস্ট হাউসের জেনারেটরও বন্ধ করে দেওয়া হল। সাহস করে গেস্ট হাউসের নীচে নেমে দেখি, কয়েকজন বসে আছেন। আলোচনার বিষয় একটাই, আমপান।
ঘরের মধ্যে থেকেই দেখতে পেলাম, একের পর এক গাছ ভেঙে পড়ছে, ভেঙে পড়ছে বিদ্যুতের খুঁটি। গেস্ট হাউসের মন্দিরের চূড়া পাঁচশো মিটার দূরে ছিটকে পড়ল। একের পর এক বাড়ির চালের টিন উড়তেও দেখলাম। ঘরে বসে সে সব দৃশ্য দেখতে হচ্ছিল অসহায় ভাবে। নড়ার উপক্রম নেই। বাইরে গেলে নিমেষে উড়িয়ে নিয়ে যাবে হাওয়া।
রাত তখন ৮টা। আরও গতি বাড়িয়ে আছড়ে পড়ল আমপান। খিদে খিদে পাচ্ছিল। কিন্তু খাবার মুখে দেওয়ার নামও করতে পারছিলাম না। প্রাণে বাঁচব কিনা, তাই তো তখন বুঝতে পারছি না!
রাত ১০টার পর ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকল প্রকৃতি। সকালের আলো ফুটলে ধ্বংসলীলা দেখার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে নিতে চোখ বুজে এল ঘুমে।
সকালে কথা হল অনেকের সঙ্গে। ঘুরে দেখলাম তাণ্ডবের চিহ্ন। প্রচুর কাঁচা বাড়ি ভেঙেছে। গাছ উপড়ে পড়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি, ট্রান্সফর্মার শুয়ে পড়েছে মাটিতে। সেচ দফতর সূত্রে জানতে পারলাম, গোসাবা ব্লকের বিভিন্ন প্রান্তে এগারোটির বেশি জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে। বিশেষ করে কালিদাসপুর, পুঁইজালি, ছোটমোল্লাখালি, তারানগর, রাঙাবেলিয়া, কুমিরমারি এলাকায় কাপুরা, রায়মঙ্গল, সারসা, বিদ্যা ও গোমর নদীর বাঁধ ভেঙে বহু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নদীর জল গ্রামে ঢুকে পড়ায় হাজার হাজার বিঘে চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুকুরের মাছও নষ্ট হয়েছে। ক্যানিং মহকুমাতেও কয়েক হাজার গাছ পড়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্তারা। ভেঙেছে বিদ্যুতের খুঁটি। বাসন্তী ব্লকের হোগল নদীর বাঁধ ভেঙে রামচন্দ্রখালি পঞ্চায়েতের তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মাতলা নদীর বাঁধ ভেঙে কাঁঠালবেরিয়া পঞ্চায়েত এলাকার দু’টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও, আরও বেশ কিছু জায়গায় নদীবাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢুকেছে। নদীর বাঁধ উপচেও বহু জায়গায় গ্রামে নোনা জল ঢুকেছে।
সেচ দফতরের কর্তাদের দাবি, নদীবাঁধ ভেঙে গেলেও বেশিরভাগ জায়গাতেই খুব দ্রুততার সঙ্গে মেরামতির কাজ শুরু করেছেন কর্মীরা। গোসাবা ব্লকের সেচ দফতরের আধিকারিক মিহির দাস বলেন, ‘‘ঝড়ের আগেই আমরা দুর্বল নদী বাঁধগুলিকে শক্ত করে বেঁধে ফেলতে সমর্থ হয়েছিলাম। ফলে বেশ কয়েকটি জায়গায় বাঁধ ভাঙলেও আমরা সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার নদীবাঁধ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি।”
গোসাবার কাপুড়া, রায়মঙ্গল, সারসা, বিদ্যাধরী নদীর বাঁধ ভেঙে বহু গ্রামে জল ঢুকেছে। বহু গ্রামে বাঁধ ছাপিয়েও নোনা জল ঢুকেছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট, মোবাইল সংযোগের অভাবে সব খবর জোগাড়ে অসুবিধা হচ্ছে।
ক্যানিংয়ের মহকুমাশাসক বন্দনা পোখরিয়াল জানিয়েছেন, বহু কাঁচাবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংখ্যাটা কত, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গ্রামের ভিতরে ভিতরে যে কী পরিস্থিতি, তা নিয়ে প্রশাসনও উদ্বিগ্ন।