ভূমিশয্যা: বিদ্যুতের খুঁটি।— বনগাঁর রামনগর রোডে ছবিটি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক
ঘূর্ণিঝড় আমপানের তাণ্ডবে বনগাঁ মহকুমা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গ্রামগুলি।
বুধবারের ঘূর্ণিঝড়ের পরে কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। এখনও মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক। বাড়িঘর ভেঙেছে, বিদ্যুতের খুঁটি, ট্রান্সফর্মার ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে। গাছ এবং ডাল ভেঙে বেশির ভাগ সড়ক এখনও অবরুদ্ধ। এরই মধ্যে চলছে জলের সমস্যা। যাতায়াতও করতে পারছেন না মানুষ। রাতের দিকে বিদ্যুতের দাবিতে বনগাঁর খয়রামারিতে শ্মশান এলাকায় অবরোধ শুরু করেন কিছু মানুষ। আটকে পড়ে শববাহী গাড়ি।
ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় অনেকেই আশ্রয় শিবিরে বা খোলা আকাশের নীচে দিন কাটছে। যাঁদের বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছে বা টালি ভেঙেছে তাঁদের অনেকেরই তা মেরামত করার মতো ক্ষমতা নেই। যাঁদের শুধু চাল উড়েছে তাঁরা ছাউনিহীন ঘরে থাকছেন। অভিযোগ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির কাছে পলিথিন পৌঁছে দেওয়া যায়নি। ফলে ঘরের ছাউনি পলিথিন দিয়ে ঢাকতে পারেননি তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে বৃষ্টি এলে তাঁদের ভেজা ছাড়া পথ থাকবে না। এরই মধ্যে মহকুমা কার্যত বিদ্যুৎহীন। কবে বিদ্যুৎ সংযোগ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে— তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না প্রশাসনিক কর্তারা।
বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যা থেকে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে গ্রামগুলি। এরই মধ্যে সাপের আনাগোনা বেড়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোনে চার্জ দেওয়া যাচ্ছে না। গ্রামবাসী আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। বিদ্যুৎ না থাকায় গ্রামের মানুষ ইন্টারনেট পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। বাড়িতে পানীয় জলের পাম্প চলছে না। গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গোবিন্দ দাস বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় পাম্প চালাতে পারছি না। অর্ধেক বালতি জলে স্নান করছি।’’ সরকারি প্রকল্পের পানীয় জল পরিষেবা বন্ধ। বাগদা, গাইঘাটা, গোপালনগর এলাকার অনেক মানুষ আর্সেনিকের কারণে পানীয় জল কিনে খান। বেসরকারি আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল তৈরির কারখানাগুলিও বিদ্যুতের অভাবে জল উৎপাদন করতে পারছেন না। ফলে ওই জল সরবরাহও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাধ্য হয়ে বহু মানুষ বাড়ির টিউবওয়েলের জল খাচ্ছেন। ওই জলে উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। বিকল্প না থাকায় তাঁদের উপায় নেই। মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের নলকূপ থাকলেও সর্বত্র তা নেই। আবার বেশ কিছু নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে আছে বাগদা, গাইঘাটা ব্লকে। গোবিন্দ বলেন, ‘‘খারাপ হয়ে যাওয়া নলকূপগুলি মেরামত করার আবেদন আগেই করা হয়েছিল প্রশাসনের কাছে।’’
পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বাগদা ব্লকে সম্পূর্ণ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৭ হাজার। বনগাঁ ব্লকে প্রায় ৫ হাজার বাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার বাড়ি-ঘর। গাইঘাটায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। বনগাঁ শহরেও বাড়িঘর ভেঙেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির দাবি, তাঁরা পর্যাপ্ত প্রশাসন পঞ্চায়েতের কাছে আবেদন করেও পর্যাপ্ত পলিথিন পাচ্ছেন না। গাইঘাটার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বলেন, ‘‘ব্লকে এই মুহূর্তে প্রায় ৪০ হাজার পলিথিন প্রয়োজন। আমাদের কাছে রয়েছে মাত্র এক হাজার পলিথিন। কী ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেব জানি না। জেলা প্রশাসনের কাছে পলিথিনের জন্য আবেদন করা হয়েছে।’’
বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘বহু কাঁচাবাড়ি এবং টিন-টালির ছাউনি দেওয়া বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পলিথিনের জন্য আবেদন করা হয়েছে।’’ বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা অবশ্য দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছেন। বনগাঁ শহরের কয়েকটি জায়গায় ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ সংযোগ চলে এসেছে। তবে মহকুমায় কবে বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক হবে তা নির্দিষ্ট করে এখনই বলা সম্ভব নয় বলে প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘এত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামলাতে কয়েকটা দিন তো সময় লাগবেই।’’