অসম-বণ্টন: দুলাল বিশ্বাস। এখনও হাত খালি। ছবি দু’টি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক
রোজ সকাল হলে ব্যাঙ্কে গিয়ে হত্যে দেন বৃদ্ধ দুলাল বিশ্বাস। দুলালের বাড়ি গাইঘাটা ব্লকে। বাড়ি বলতে যা বোঝায় তা অবশ্য নেই। ছিল অবশ্য আপমানের আগে। ঝড়ে চাল উড়েছে, দেওয়াল ভেঙেছে। দেখা গেল, চৌখুপির ভিঁতটাই কেবল রয়েছে। পরিবারের সদস্য পাঁচ জন। আত্মীয় বাড়িতে দিন কাটছে তাঁদের।
দুলালের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এখনও ক্ষতিপূরণের টাকা ঢোকেনি। দুলাল বলেন, “নতুন করে ঘর তৈরির সামর্থ্য আমার নেই। ক্ষতিপূরণ অনেকেই পেয়ে গিয়েছেন। আমি বোধ হয় আর পাব না।” ওই বৃদ্ধ ক্ষতিপূরণ না পেলেও একই পরিবারের একাধিক সদস্য টাকা পেয়েছেন। ক্ষতি হয়নি এমন পাকা বাড়ির মালিকও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। বলে এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছ থেকে নতুন করে আবেদন জমা নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। সে জন্য গাইঘাটা ব্লক অফিসে ২০টি কাউন্টার খোলা হয়েছে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার প্রায় ৮ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। শনিবার পর্যন্ত ওই আবেদন জমা নেওয়া হয়। গাইঘাটার বিডিও বিব্রত বিশ্বাস জানিয়েছেন, সোমবার থেকে আবেদনগুলি খতিয়ে দেখা হবে। পঞ্চায়েত স্তরের ৪ জনের কমিটির পাশাপাশি ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকেরাও আবেদনপত্র খতিয়ে দেখবেন। নতুন করে আবেদন করতে বহু মানুষের ভিড় হচ্ছে ব্লক অফিসে। দূরত্ববিধি শিকেয় উঠেছে।
গাইঘাটার ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত ক্ষতিগ্রস্তদের যে তালিকা তৈরি করেছিল, তা নিয়ে সর্বত্র ক্ষোভ ছিল। তালিকায় নাম ছিল প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষের। এখনও পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন মাত্র হাজারখানেক মানুষ। গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ ধ্যানেশনারায়ণ গুহর সাফাই, “একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ভুল অ্যাকাউন্ট নম্বর, আইএফএসসি কোড ভুল থাকায় বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত টাকা পাননি।”
এই পঞ্চায়েত এলাকায় শাসক দলের নেতা-কর্মীরা তো বটেই জনপ্রতিনিধিরাও ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন বলে অভিযোগ। গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির এক মহিলা সদস্য এবং তাঁর স্বামীর নামে বাড়ি ভাঙার ক্ষতিপূরণের টাকা ঢুকেছে বলে জানা গিয়েছে। সেই সদস্য স্বীকারও করেছেন সে কথা। তিনি বলেন, “যে মুহূর্তে টাকা ঢুকেছে জেনেছি, সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনকে জানিয়েছি, তা ফেরত দেব।”
এমন ঘটনা ঘটল কেমন করে? ওই সদস্যের যুক্তি, “পাড়ার ছেলেরা তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দিয়ে থাকতে পারে।” এমন যুক্তিতে বিস্মিত প্রশাসনের এক কর্তা। তাঁর প্রশ্ন, “জনপ্রতিনিধির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য পাড়ার ছেলেরা জানবে কেমন করে!” গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গোবিন্দ বিশ্বাস জানান, ওই জনপ্রতিনিধিকে টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
গাইঘাটার ব্লক বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের আধিকারিক সর্বজ্যোতি ভট্টাচার্য বলেন, “তদন্তে এখনও পর্যন্ত পাঁচজনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যাঁদের অ্যাকাউন্টে ভুল করে টাকা ঢুকেছে। ওই সংখ্যাটা আরও বাড়বে।” প্রশাসনের কর্তাদের সাফাই, পঞ্চায়েতগুলি তালিকা তৈরির জন্য দু’দিন সময় পেয়েছিল। সে জন্যই এত ভুল হয়েছে। কিন্তু ‘ভুল ব্যক্তির’ নির্ভুল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর কী ভাবে পাওয়া গেল, সেই বিতর্কের মীমাংসা হচ্ছে না।
শনিবার ১৩টি পঞ্চায়েতের চারজনের কমিটির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন গোবিন্দ। স্বচ্ছতার অভাবেই যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় বেনোজল ঢুকেছে, তা তিনি স্বীকার করে নেন। বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত নন, অথচ যাঁরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, টাকা ফেরত না দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা হবে। প্রথম তালিকার প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তেরা অবশ্যই ক্ষতিপূরণ পাবেন।”
অন্য দিকে, সোমবার গাইঘাটার রামনগর পঞ্চায়েত অফিসে চড়াও হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা আর্থিক ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ক্ষিপ্ত মহিলাদের দাবি, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তেরা টাকা না পেলেও পাকা বাড়ি, ক্ষতিগ্রস্ত নন, এমন মানুষেরা টাকা পেয়েছেন।