বর্ণালী ধাড়া। —ফাইল চিত্র।
সামান্য গৃহবধূ থেকে হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর চাষি!
ধাপে ধাপে চাষের কাজে নিয়ে আসেন এলাকার মহিলাদেরও। এ ভাবেই প্রায় হাজার দু’য়েক মহিলাকে চাষের কাজে স্বনির্ভরতার দিশা দেখানো বর্ণালী ধাড়া এ বার ‘বিশিষ্ট চাষি’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাচ্ছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপির প্রত্যন্ত অশ্বত্থতলা গ্রামের বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের বর্ণালী ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে পুরস্কার নেবেন। এ বার সারা দেশ থেকে দশ জন ‘বিশিষ্ট চাষি’র পুরস্কার পাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পুরস্কার পাচ্ছেন একমাত্র বর্ণালীই।
বর্ণালীর বাপের বাড়ি কাকদ্বীপে। বাবা-মা শিক্ষকতা করলেও বাড়িতে চাষবাসের চল ছিল। স্বামী এক সময়ে কৃষিকাজ ও সার-কীটনাশকের ব্যবসা করতেন। পরে তিনি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পান। সে সময়ে পারিবারিক ব্যবসা তথা চাষবাসের হাল ধরেন বর্ণালী। সেটা ২০০৫ সাল। ইতিমধ্যে এলাকার জনা দশেক মহিলাকে নিয়ে একটা স্বনির্ভর গোষ্ঠীও শুরু করেন। নানা কাজের মাধ্যমে তাঁদের আয়ের ব্যবস্থা করেন। ক্রমশ তাঁর দলে মহিলাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁদের নিয়ে তৈরি করেন ‘অশ্বত্থতলা মহিলা জনকল্যাণ সমিতি।’
২০১৭ সাল নাগাদ সার-কীটনাশক বিক্রির প্রশিক্ষণ নিতে বর্ণালী আসেন জয়নগরের নিমপীঠ রামকৃষ্ণ আশ্রম কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রে। নতুন দিগন্ত খুলে যায় তাঁর সামনে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে পারেন। সেই সব প্রকল্পের মাধ্যমে দলের মহিলাদের স্বনির্ভর করতে উদ্যোগী হন। হাইব্রিড সূর্যমুখী বীজ চাষের সরকারি প্রকল্পে মহিলাদের যুক্ত করে প্রায় একশো বিঘা জমিতে বীজের চাষ শুরু করেন। সরকারের দেওয়া নারকেল চারা নিয়ে কয়েকশো মহিলাকে দিয়ে নারকেল চাষ করান। গ্রামের মহিলাদের কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আবার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞদের এলাকায় নিয়ে যান। জেলা প্রশাসন বা বন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেও চাষের নানা প্রকল্প এলাকায় নিয়ে আসা শুরু করেন তিনি। হাঁস, মুরগি, ছাগল পালনেও যুক্ত করেন বহু মহিলাকে। এ ভাবেই বর্তমানে প্রায় দু’হাজার মহিলা তাঁর নেতৃত্বে চাষাবাদের কাজে যুক্ত হয়েছেন। এলাকার অনেক পুরুষও এই সব প্রকল্পে চাষ করছেন। তাঁদের নিয়ে এফপিসি (ফার্মার্স প্রডিউসার কোম্পানি), এফআইজি (ফার্মার্স ইন্টারেস্ট গ্রুপ) তৈরি করেছেন বর্ণালী। এমনকী, এলাকার কৃষকদের সুবিধায় বিন্দু সেচ, বারি সেচ ব্যবস্থাও শুরু করেছেন।
বর্ণালীর কথায়, “এক সময়ে হাঁড়ি-হেঁসেল সামলাতাম। ঘটনাচক্রে চাষের কাজে যুক্ত হয়ে পড়ি। কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে এসে বুঝতে পারি এই কাজেও প্রচুর সুযোগ রয়েছে। এলাকার মহিলাদের নিয়ে আগে থেকেই কাজ করতাম। ঠিক করি, মহিলাদের এই কাজে যুক্ত করতে হবে। সব সময়ে চেয়েছি মহিলারা ঘরের কাজের পাশাপাশি নিজেরা রোজগার করুক। ভাবিনি, রাষ্ট্রপতির স্বীকৃতি মিলবে। সামান্য গৃহবধূ হয়ে দেশের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেব, ভাবলেই গর্ব হচ্ছে!”
নিমপীঠ রামকৃষ্ণ আশ্রম কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান তথা কৃষিবিজ্ঞানী চন্দনকুমার মণ্ডল বলেন, “উনি শিক্ষার্থী হিসেবে এখানে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে মহিলাদের একত্রিত করে নতুন নতুন চাষে উৎসাহিত করা দেখে আমরাও সব রকম ভাবে পাশে দাঁড়াই। এটা আমাদের কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের কাছেও একটা বড় স্বীকৃতি।”