জরাজীর্ণ: দীনবন্ধু মিত্রের বাড়ি। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
দেওয়াল থেকে পলেস্তারা খসে বেরিয়ে এসেছে ইট। সেই ইটেও ধরেছে ক্ষয়। মাথার উপর খোলা আকাশ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এখানে কোনও দিন ছাদ ছিল। আগাছা গজিয়েছে দেওয়াল জুড়ে। জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। বিষাক্ত সাপের আস্তানা হয়েছে এখন। এমনই অবস্থা নীলদর্পণ নাটকের স্রষ্টা দীনবন্ধু মিত্রের গোপালনগরের চৌবেড়িয়ার বাড়ির।
পরিবারের লোকজন ও এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি, জরাজীর্ণ বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার। বছর নয়েক আগে খাতা কলমে সরকারি ভাবে বাড়িটি হেরিটেজ ঘোষণা হয়েছে ঠিকই, তবে বাস্তব বাড়িটি আজও অবহেলায় পড়ে আছে। এ নিয়ে এলাকার মানুষজন ক্ষুব্ধ।
১৮২৯ সালের ১০ এপ্রিল ওই বাড়িতে জন্মেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। তাঁর শৈশব এবং বাল্যশিক্ষা হয়েছিল এখানেই। পরবর্তী সময়ে তিনি বাবা কালাচাঁদের সঙ্গে কলকাতায় চলে যান। কিন্তু এখানে ফিরে এসেছেন বারবার ।
শুক্রবার ছিল নাট্যকারের মৃতুদিন। ১৮৭৩ সালের ১ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুদিনে নাট্যকারের মূর্তিতে সরকারি ভাবে মাল্যদান হয়নি। হয় না কোনও অনুষ্ঠানও। আজ যে নাট্যকারের মৃত্যুদিন ছিল তা বনগাঁ মহকুমার লোকজনের কাছে অজানা নয়। কিন্তু তাঁর জন্য কিছুই করলেন না বনগাঁবাসী। বাড়িতে থাকা নাট্যকারের আবক্ষ মূর্তিতে কোনও মালা পড়েনি। আবক্ষ মূর্তির গলায় দীর্ঘদিনের একটি ফুলের মালা শুকিয়ে রয়েছে। তবে মূর্তির পাশে গজিয়ে ওঠা শিউলি গাছ থেকে কিছু ফুল পড়েছে মূর্তিটির নীচে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, দীনবন্ধুর বশংধর সঞ্জিত মিত্র একটি ফুলের মালা এনে আবক্ষ মূর্তিতে পরিয়ে দিলেন। হতাশ বললেন, ‘‘নাট্যকারের এই অনাদর অবহেলা কি প্রাপ্ত ছিল। মৃত্যু দিনে সরকারি ভাবে একটা মালা দেওয়া হল না।’’
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, এই বাড়িতেই এসেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি ঈশ্বর গুপ্ত এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । এই বাড়িতে বসেই লেখা হয়েছিল নীলদর্পণ নাটকের কিছুটা অংশ। পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রূপলেখা তৈরি হয়েছিল এখানেই।
অভিযোগ, ইতিহাসের সাক্ষী এই বাড়িটির সংরক্ষণ নিয়ে বহুদিন ধরেই উদাসীন থেকেছে প্রশাসন। কয়েক বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ভগ্নদশা বাড়িটির সামনে দীনবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি বসানো হয়। এর বাইরে বাড়িটি সংস্কার বা সংরক্ষণের কোনও সরকারি প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি।
সারা বছর ধরে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ নাট্যকারের বাড়িতে আসেন। কিন্তু ভগ্নদশা বাড়িতে দেখে তাঁরা ব্যথিত হন। এখানে এলে নাট্যকার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেও পারেন না তাঁরা।
প্রশাসনের তরফে দীর্ঘদিন ধরে বলা হত, সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করুক পরিবারের লোকজন তা চান না। এখন অবশ্য সময় বদলেছে। পরিবারের লোকজন অনুমতি দিয়েছেন বহুদিন আগেই। নাট্যকারের বংশধর সুশীল মিত্র বলেন, ‘‘আমরা চাই সরকার বাড়িটিকে সংস্কার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুক। অতীতে একবার হেরিটেজ কমিশন থেকে প্রতিনিধিরা বাড়িতে এসে মাপজোক করেছিলেন। তারপর আর কিছুই এগোয়নি। আমরা অনেক দিন আগেই সরকারকে লিখিত ভাবে সম্মতি দিয়ে দিয়েছি।’’
অন্য এক বংশধর সত্যেন মিত্র বলেন, ‘‘২০১০ সালে হেরিটেজ কমিশিন বাড়িটি হেরিটেজ ঘোষণা করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ওদের একটি ফর্ম পূরণ করে এখানে গ্রন্থাগার পাঁচিল-সহ নানা দাবি করেছিলাম। তারপর আর কিছু হয়নি।’’ বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘হেরিটেজ কমিশন এখন বিষয়টি দেখছে।’’ বনগাঁর মহকুমাশাসক কাকলি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাড়িটিকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্রে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে।’’