প্রতীকী ছবি।
ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় কলকাতার দুর্গাপুজো জায়গা করে নিয়েছে (দুর্গাপুজো ইন কলকাতা)। ঘোষণা শুনে খুশির জোয়ার বাঙালি সমাজে। খুশি মৃৎশিল্পীরাও। গৌরবান্বিত বোধ করছেন তাঁরা। কিন্তু এই সম্মান তাঁদের আর্থিক হাল ফেরাবে কিনা, সে প্রশ্ন এখন অনেকেরই মনে।
বনগাঁ শহরে প্রতি বছর বড় আকারে দুর্গাপুজো হয়। থিম ও আলোর মিশেলে উজ্জ্বল সেই পুজো দেখতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ভিড় করেন। ওপার বাংলা থেকেও অনেকে আসেন। পুজোর সময়ে মৃৎশিল্পীরা বাড়তি আয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দুর্গা প্রতিমা বিক্রির আয় থেকেই কার্যত বছরের মূল রোজগার আসে।
করোনা পরিস্থিতিতে মৃৎশিল্পীদের রুজিরোজগার কমিয়ে দিয়েছে। সরকারি সাহায্যও মেলে না। বনগাঁর মৃৎশিল্পী লক্ষ্মণ পাল, গোপাল পাল ইউনেস্কোর ঘোষণা শুনেছেন। লক্ষ্মণের কথায়, ‘‘ঘোষণা শুনতে তো ভালই লাগে। তবে আমাদের পরিস্থিতির তো কোনও পরিবর্তন হয় না।’’ একরাশ হতাশা দু’জনের গলায়। মৃৎশিল্পীরা জানালেন, করোনা পরিস্থিতিতে পুজো উদ্যোক্তারা বাজেট কমিয়েছেন। তার প্রভাব পড়েছে প্রতিমার ক্ষেত্রে। এক মৃৎশিল্পীর কথায়, ‘‘প্রতিমা তৈরির উপকরণের মূল্য বেড়ে গিয়েছে। অথচ উদ্যোক্তারা প্রতিমার জন্য বাজেট বাড়াতে রাজি নন। ক্ষতি শিকার করেও প্রতিমা তৈরি করতে হচ্ছে।’’
করোনা পরিস্থিতিতে প্রতিমা তৈরির জন্য শ্রমিক কমেছে। এ দিকে, যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা প্রায় দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দাবি করেছেন বলে জানালেন শিল্পীরা। সব মিলিয়ে দুর্গা প্রতিমা শিল্পীরা অনটনে ভুগছেন। অনেকেই জানালেন, স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে বা ধারদেনা করে প্রতিমা গড়েন। বন্যা পরিস্থিতি বা করোনার মতো পরিস্থিতিতে তাঁদের বায়না করা প্রতিমা কেউ নিয়ে যায় না। লোকসানে ডুবে যেতে হয়। এক মৃৎশিল্পীর কথায়, ‘‘জলে চাষ নষ্ট হলে সরকার যদি আর্থিক সাহায্য করে, তা হলে আমাদের বাজার মন্দা হলেই বা সরকারি সাহায্য মিলবে না কেন?’
দেগঙ্গার বেড়াচাঁপা এবং বিশ্বনাথপুর এলাকায় কয়েকশো মৃৎশিল্পী বংশ পরম্পরায় প্রতিমা তৈরি করেন। সেই আয়েই চলে সংসার। শিল্পীরা জানালেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়না না থাকায় অনেকে প্রতিমা তৈরির ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবছেন।
বিশ্বনাথপুর পালপাড়ার প্রতিমা শিল্পী সুদিন পাল জানান, লকডাউনের আগে ২২-২৫টি দুর্গা প্রতিমার বরাত পেতেন। গত দু’বছরে অর্ধেকেরও কম প্রতিমা বানিয়েছেন। সুদিন বলেন, “গত দু’বছর ধরে সকলেই কম বাজেটের পুজো করছেন। চাহিদা না থাকায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে প্রতিমার দাম। অথচ শ্রমিকের মজুরির পাশাপাশি সরঞ্জামের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।’’
তাঁর দাবি, “আমাদের উৎসব বিশ্বের মঞ্চে স্থান পেয়েছে, এটা খুবই ভাল। তবে আমাদের তা নিয়ে বিশেষ আনন্দ নেই। সরকার যদি ভাতার ব্যবস্থা করে, তা হলে প্রতিমা তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে পারি।”
স্থানীয় প্রতিমা শিল্পী দীপক পাল বলেন, “লকডাউনের পরে ব্যবসা খুবই মন্দা যাচ্ছে। আগামী দিনে আদৌ এই কাজ চালিয়ে যেতে পারব কিনা, জানি না।” শিল্পী রমা পাল জানালেন, করোনা পরিস্থিতিতে খুবই কষ্টে দিন কাটছে। আমপানে ঘরের চাল উড়ে গেলেও সরকারি সাহায্য পাননি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারি সাহায্যের আবেদন জানান তিনি। তাঁর কথায়, “আগে লোক রেখে কাজ করাতে হত। এখন আয় কমেছে। আর লোক রাখতে পারি না। নিজেরাই যেটুকু পারি, করি। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার আমাদের পাশে দাঁড়াক। অন্তত কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলেও কিছুটা সুরাহা হবে।”