অঞ্জনকুমার দত্ত এবং রফিকুর রহমান। নিজস্ব চিত্র।
একজন থানার আইসি, অন্যজন এলাকার বিধায়ক। অথচ, দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ প্রায় আট মাস। দেখা-সাক্ষাৎ কার্যত হতই না। এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়, আমডাঙা থানার আইসি অঞ্জনকুমার দত্তের সঙ্গে আমডাঙার তৃণমূল বিধায়ক রফিকুর রহমানের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছিল।
থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, আইসি বিধায়কের ফোন নম্বরটি ব্লক করে দিয়েছিলেন। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিধায়ক যেন থানায় না আসেন। ওঁর সঙ্গে কোনও কথা হবে না। বিধায়কও সাম্প্রতিক সময়ে আইসির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তোলেন। আইসির অপসারণ দাবি করেন।
দু’জনের মধ্যে সংঘাতের এই আবহে শুক্রবার আইসির বদলির নির্দেশ এসেছে। তাঁকে হাওড়া কমিশনারেট বদলি করা হয়েছে। তাঁর জায়গায় আমডাঙা থানার নতুন আইসি হচ্ছেন রাজকুমার দেবনাথ। বারাসতের পুলিশ সুপার রাজনারায়ণ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা রুটিন বদলি।’’
বিধায়কের চাপেই আইসিকে বদলি করা হল কি না, সে প্রশ্ন উঠছে। পুলিশের একাংশ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তেমনটাই মনে করছে। সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সদস্য সাহারাব মণ্ডল বলেন, “এই আইসি আসার পর থেকে বিধায়কের খানিকটা অসুবিধা হচ্ছিল। সেটা আমরা লক্ষ্য করেছিলাম। তাঁর নিজস্ব স্বার্থে আঘাত লাগছিল। আগে অন্যান্য আইসিদের দিয়ে বিধায়ক সিপিএমের কর্মীদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন। এই আইসির সময়ে সেটা খুব বেশি করতে পারছিলেন না। তাই পঞ্চায়েত ভোটের আগে আইসিকে সরিয়ে দেওয়া হল।” আইসির সময়কালে এলাকায় মাদক কারবার নিয়ন্ত্রিত ছিল বলে দাবি সাহারাবের। বিজেপির ব্যারাকপুর সাংগঠনিক জেলার সহ সভাপতি অরিন্দম দে বলেন, “বিধায়কের নিকট আত্মীয়-পরিজনেরা বেআইনি মাটি কাটা-সহ নানা অনৈতিক কাজে যুক্ত। তৃণমূলের অনেকেও অনৈতিক কাজে যুক্ত। আইসি এ সবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন। বিধায়ক মনে করেছেন, এই আইসিকে দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট করানো যাবে না। তিনি আইসিকে সরানোর চেষ্টা করেছেন, ফলও পেয়েছেন।”
বদলির নির্দেশ নিয়ে আইসি অঞ্জনকুমার কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বিধায়ক বলেন, “পুলিশের চাকরি বদলির চাকরি। আইসি বদলি হয়েছেন। নতুন যিনি আসছেন, চাইব তিনি আইন মেনে কাজ করুন।”
আমডাঙা থানার আইসি হিসাবে প্রায় দেড় বছর আগে কাজে যোগ দেন অঞ্জন। প্রথম কয়েক মাস সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও তারপর থেকেই বিরোধ শুরু হয় বিধায়কের সঙ্গে। পুলিশের একাংশ জানাচ্ছে, এলাকায় বেআইনি ভাবে মাটির কারবার, তোলাবাজি, গাঁজা চাষ, মাদকের কারবার আইসি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ সব নিয়ে বিধায়কের সঙ্গে বিবাদের সূত্রপাত। অভিযোগ, বিধায়কের অনেক দাবি আইসি মানতে চাননি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আইসির বিরুদ্ধে একাধিকবার তোপ দেগেছিলেন রফিকুর। রফিকুরের অভিযোগ ছিল, আইসি মাদকের কারবারে মদত দিচ্ছেন। অঞ্জনকে মাদকের কারবারি (স্টকিস্ট) বলেও দাবি করেছিলেন বিধায়ক। ওই অভিযোগের পরে আইসির স্ত্রী বিধায়কের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন বলে জানিয়েছিলেন। প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।
পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, আইসির সময়কালে গাঁজা পাচারের বড়সড় কারবারিরা গ্রেফতার হয়েছে। এক সঙ্গে প্রচুর গাঁজা উদ্ধার হয়েছে। গত দেড় বছরে ৮ জন গাঁজা পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তরল মাদক ও বেআইনি ভাবে বিক্রি হওয়া মদ আটক হয়েছে। আমডাঙার প্রাচীন করুণাময়ী মন্দিরে চুরির ঘটনার পরে দুষ্কৃতীরা গ্রেফতার হয়েছে। চুরি যাওয়া গয়না উদ্ধার করেছে পুলিশ। শিলিগুড়ির এক ব্যবসায়ীর ২৬ লক্ষ টাকা ছিনতাই হয়। পুলিশ ৯ জনকে গ্রেফতার করে। টাকা উদ্ধার হয়। পুলিশের দাবি, দেড় বছরে সমাধান হয়নি, এমন কোনও ঘটনা নেই।
তৃণমূলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য তথা বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত ভোট করাতে আমাদের কোনও ওসি বা আইসি বদলি করার প্রয়োজন নেই। গত পঞ্চায়েত ভোটে জেলায় বিরোধীরা যে ক’টি আসন পেয়েছিল, এ বার তা-ও পাবে না। আইসির রুটিন বদলি হয়েছে।’’