অবহেলা: এখানে ম্যানগ্রোভের বীজ ছড়ানো হলেও বর্তমানে তার কোনও চিহ্ন নেই। ন্যাজাট ২ পঞ্চায়েতের পাটনিপাড়ায় তোলা নিজস্ব চিত্র
গত কয়েক বছরে দুই জেলার সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকায় একশো দিনের কাজেই মূলত নদী তীরে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, সঠিক পরিচর্যা হয়নি। ফলে বহু চারা নষ্ট হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে একশো দিনের কাজে টাকাও বন্ধ। ফলে ম্যানগ্রোভের নার্সারিরও পরিচর্যা বন্ধ। লক্ষ লক্ষ ম্যানগ্রোভের চারা নষ্ট হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে নতুন করে কেন্দ্রীয় বাজেটে নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় একশো দিনের কাজে ম্যানগ্রোভ রোপণের কথা ঘোষণা হওয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সুন্দরবনের মানুষের। অনেকের মতে, ম্যানগ্রোভ আরও বেশি বেশি করে লাগালে সুন্দরবন বাঁচবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে। আবার অনেকের মতে, খাতায়-কলমে প্রকল্প করলেই তো হল না। গাছ লাগিয়ে তাকে বাঁচাতে হবে। যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের মজুরি দিতে হবে। তবেই প্রকল্পের সার্থকতা।
গোসাবার রাঙাবেলিয়া পঞ্চায়েতের বাসিন্দা সুজিত জানা, সুরভী সর্দারেরা জানান, একশো দিনের প্রকল্পে ম্যানগ্রোভের চারা পোঁতা হবে বলা হল। কিন্তু কাজ করে টাকা মিলবে তো? সুজিত বলেন, ‘‘গত বছর চারা তৈরি করেছি। কিন্তু টাকা পাইনি। আমরা যাতে কাজ করে ঠিক মতো টাকা পাই, সে বিষয়টা দেখা উচিত।’’ একই বক্তব্য ক্যানিংয়ের নিকারিঘাটা পঞ্চায়েতের বাসিন্দা সুধীর মণ্ডল, নিতাই দাসেদের।
ওই পঞ্চায়েতের প্রধান তাপসী সাঁফুই বলে, ‘‘আমরা গত বেশ কয়েক বছর ধরেই লক্ষ লক্ষ ম্যানগ্রোভ চারা তৈরি করে মাতলা নদীর চরে বসিয়েছি। একশো দিনের কাজেই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এই ধরনের কাজের আরও সুযোগ এলে এলাকার মানুষ উপকৃত হবেন। তবে কেন্দ্র নিজেদের ইচ্ছে মতো প্রকল্পের টাকা বন্ধ করে দেওয়ায় বহু চারাগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’’
সন্দেশখালি ১ ও ২, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ ব্লকের বিভিন্ন নদীর চরে বিভিন্ন সময়ে একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু অনেক জায়গায় ম্যানগ্রোভ ভাল হয়নি। কোথাও কোথাও এক বছরের মধ্যে সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
সন্দেশখালি ২ ব্লকের মণিপুর পঞ্চায়েত সূত্রের খবর, বছরখানেক আগে রায়মঙ্গল নদীর তীরে বোয়ালিয়ার চরে, আতাপুরের একটি অতিথি নিবাসের পাশ থেকে মনসা মাহাতোর বাড়ি পর্যন্ত কলাগাছি নদীর চরে, গোপালের ঘাট থেকে আতাপুর স্লুস গেট পর্যন্ত ও আতাপুর রবিন মণ্ডলের বাড়ির পাশে নদীর চরে ম্যানগ্রোভের বীজ রোপণ করা হয়। ঘিরেও দেওয়া হয়।
তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে মানছেন প্রধান প্রসেনজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘বার বার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে নদীর জলস্তর বেড়ে চর তলিয়ে গিয়েছে। ফলে এই জায়গায় ম্যানগ্রোভ খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ, এক একটা স্কিমে প্রায় ৯৩ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে।’’
এই ব্লকের দুর্গামণ্ডপ পঞ্চায়েতের সুখদুয়ানি রথপাড়া, সুখদুয়ানি দয়ালচাঁদ বিদ্যাপীঠ স্কুলের পাশে বালি নদীর চরে গত বছর ছড়ানো ম্যানগ্রোভের বীজ থেকে গাছ তেমন হয়নি বললেই চলে। প্রধান লক্ষ্মণ অধিকারী তা মেনে নিয়ে বলেন, ‘‘এই জায়গাগুলিতে নদীর ভাঙন-সহ বিভিন্ন কারণে ম্যানগ্রোভ ভাল হল না। তবে কয়েকটি জায়গায় ভাল ম্যানগ্রোভ হয়েছে।’’ কোরাকাটি পঞ্চায়েতের বেশ কয়েকটি জায়গায় গত বছর নদীর চরে ম্যানগ্রোভের বীজ ছড়ানো হয়। ঘিরেও দেওয়া হয়। তবে এখন সেখানে ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এর প্রধান কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
হিঙ্গলগঞ্জের গোবিন্দকাটি পঞ্চায়েত সূত্রের খবর, কালিন্দী নদীর চরে গত বছর ম্যানগ্রোভের বীজ রোপণ করে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গাছ তেমন হয়নি। এই প্রসঙ্গে প্রধান সঞ্জীব মণ্ডল বলেন, ‘‘অনেক জায়গায় বীজ থেকে গাছ বেরোয়নি। কোথাও বীজ নদীর ঢেউ বা অন্যান্য কারণে নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া, স্থানীয় মৎস্যজীবীদের কেউ কেউ মাছ ধরার জন্য ম্যানগ্রোভের ঘেরা অংশ ভেঙে ফেলেন। সেই ভাঙা অংশ দিয়ে গরু-ছাগল চারা খেয়ে নষ্ট করে।’’
সন্দেশখালি ১ ব্লকের ন্যাজাট ২ পঞ্চায়েতের পাটনি পাড়া, গাজিখালি খেয়াঘাটের পাশে ও বানতলায় বিদ্যাধরী নদীর চরে ২০১৮-২০১৯ সাল নাগাদ ম্যানগ্রোভের বীজ ছড়ানো হয়। তবে বেশিরভাগ জায়গায় গাছ তেমন হয়নি। যে দু’একটা গাছ হয়েছিল, তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। চরও নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একই পরিস্থিতি হাসনাবাদ ব্লকের পাটলি খানপুর পঞ্চায়েতেরও।
সন্দেশখালি ২ ব্লকের বিডিও অর্ণব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষকে ম্যানগ্রোভ রক্ষায় সচেতন হতে হবে। না হলে চারা রক্ষা করা কঠিন। তবে অনেক জায়গায় ম্যানগ্রোভ ভাল হয়েছে।’’