ভেঙে গেছে দোকান। মৃত স্বপন ঘোষ (ইনসেটে) ছবি: সুজিত দুয়ারি।
রাত তখন প্রায় ৯টা। অশোকনগরের শেরপুর পাঁচ রাস্তার মোড় এলাকা অন্যান্য দিনের মতোই জমজমাট। দোকানপাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়। আচমকা একটি ট্রাক বেপরোয়া গতিতে এসে পর পর ধাক্কা মারল একটি বাইক, ফলের দোকান, পুলিশের অব্যবহৃত ট্রাফিক বুথে। পরে একটি চপের দোকানে ধাক্কা মেরে দাঁড়িয়ে যায়। ভয়াবহ এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এক ফল বিক্রেতার। জখম আরও চার জন।
এলাকার মানুষ এবং পথচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। রাস্তা অবরুদ্ধ থাকে প্রায় দু’ঘণ্টা। পুলিশ ক্রেন এনে ট্রাক সরানোর ব্যবস্থা করে। দেহ উদ্ধার করা হয়। বাসিন্দারা এলাকায় যান নিয়ন্ত্রণের দাবি তুলেছেন। বৃহস্পতিবার রাতের এই ঘটনায় পুলিশ ট্রাক আটক করেছে। চালকের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে। গাফিলতির জেরে মৃত্যুর মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
মৃতের নাম স্বপন ঘোষ (৫৪)। এলাকায় তিনি ‘কানুদা’ বলে পরিচিত। আগে আনাজ বিক্রি করতেন। লকডাউনের সময় থেকে ফল বিক্রি শুরু করেন। পাঁচ রাস্তার মোড়ে রাস্তার পাশেই ভ্যানে ফল সাজিয়ে বিক্রি করতেন। স্বপনের বাড়ি স্থানীয় ৫ নম্বর তরুণপল্লি এলাকায়। অভাবের সংসার। বাড়িতে আছেন বৃদ্ধা মা মনোরমা, স্ত্রী অসীমা এবং একমাত্র মেয়ে পায়েল। পায়েল হাবড়ার শ্রী চৈতন্য কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। স্বপন বাড়ির একমাত্র রোজগেরে ছিলেন।
পায়েলই বাবাকে ভ্যানে ফল সাজিয়ে দিতেন। বললেন, “আর হয় তো পড়াশোনা চালাতে পারব না। কী ভাবে সংসার চলবে জানি না। বিধায়ক-পুরপ্রধানের কাছে আবেদন, যদি আমাকে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেন, তা হলে সংসার চালিয়ে পড়াশোনাটাও করতে পারব।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে ওই ট্রাকটি অশোকনগর থানার দিক থেকে এসে শেরপুর পাঁচ রাস্তার মোড় এলাকায় খারাপ হয়ে যায়। বাসিন্দাদের সহযোগিতায় ট্রাকটি সরিয়ে রাখা হয়। বাসিন্দারা চালককে জানান, ট্রাকটি মিস্ত্রি দেখিয়ে ঠিক করে তারপর চালাতে। অভিযোগ, চালক তা না শুনে ট্রাক চালু করেন। ব্রেক ফেল করে ট্রাক দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করে। প্রথমে চলন্ত একটি বাইকে ধাক্কা মারে। চালক ছিটকে পড়ে জখম হন। বাইকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপরে ট্রাকটি ধাক্কা মারে একটি চপের দোকানে। দোকান গুঁড়িয়ে যায়। জখম হন চপের দোকানের মালিক অশোক বর্মণ ও কর্মচারী বিশ্বজিৎ মজুমদার। দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কড়াইয়ের গরম তেল ছিটকে শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গিয়েছে অশোকের। এরপরে ট্রাকটি ট্রাফিক বুথে ধাক্কা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়। পাশেই স্বপনের ফলের দোকান। ট্রাকের ধাক্কায় ভ্যান গুঁড়িয়ে যায়। এক জন ফল কিনছিলেন। তিনি মাথায় আঘাত পান। আতঙ্কে মানুষ চিৎকার-ছোটাছুটি শুরু করেন।
ওই এলাকার চাউমিন-এগরোলের দোকান আছে রতন সাহার। তিনি বলেন, “দোকানে ভিড় কম থাকায় চপের দোকানে গিয়ে চপ কিনে খাচ্ছিলাম। পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। মৃত্যুকে বড় কাছ থেকে দেখলাম!” ৫ নম্বর তরুণপল্লির বাসিন্দা প্রদীপ সাহার কথায়, “আমিও চপ খাচ্ছিলাম। শৌচালয়ে যাব বলে দুর্ঘটনার দু’মিনিট আগে ওখান থেকে সরে গিয়েছিলাম বলে এখনও বেঁচে আছি!”
বাসিন্দাদের অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়ে যান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও ট্রাফিক ব্যবস্থা নেই। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা অনেক দিন ধরে খারাপ। এ দিনই রাত ১১টা নাগাদ দু’টি বাইকের মধ্যে ধাক্কা লাগে। গত বছর অগস্ট মাসে বেপরোয়া বাইকের ধাক্কায় এক ক্রীড়া সংগঠকের মৃত্যু হয়েছিল। তারপরে পুলিশ তৎপর হয়ে বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধ করে। তবে এখন পরিস্থিতি আবার আগের মতো বলেই অভিযোগ। অশোকনগরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সত্যসেবী কর বলেন, “শহর জুড়ে বেপরোয়া বাইক-যানবাহন চলছে।”
পুলিশ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনার পরে শেরপুর পাঁচ রাস্তার মোড় এলাকায় গার্ড রেল দেওয়া হয়েছে। যান নিয়ন্ত্রণের জন্য সিভিক ভলান্টিয়ার মোতায়েন করা হচ্ছে।