হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস। ছবি: পিটিআই।
তাদের পরিকাঠামো আন্তর্জাতিক মানের বলেই বিশেষজ্ঞদের মত। এ-ও বলা হয়, হলদিয়া রিফাইনারি আর হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস্ হল শিল্পশহরের হৃৎপিণ্ড।
হলদিয়া শহরের বুকে সেই সংস্থার ‘মাদার প্ল্যান্টে’ই অগ্নিকাণ্ড হল শুক্রবার। ঝলসে গেলেন আধিকারিক ও কর্মী-সহ মোট ১৩ জন। জখম সকলকে তড়িঘড়ি উদ্ধার করে কলকাতায় পাঠানো হল। তাঁদের অবাধে পৌঁছে দিতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে হলদিয়া থেকে কলকাতা তৈরি হল ‘গ্রিন করিডর’।
২০০০ সালের ২ এপ্রিল পথচলা শুরু হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস (এইচপিএল)-এর। মূলত পলিমার জাতীয় দ্রব্য তৈরি করে এই সংস্থা। প্রায় দু’দশকের ইতিহাসে সংস্থায় এমন বড় মাপের অগ্নিকাণ্ড এর আগে হয়েছে একবারই, ২০০৯ সালের জুলাইয়ে। সে বারও আগুন লেগেছিল কারখানার ন্যাপথা ক্র্যাকার ইউনিটে।
এ দিন আহত ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনকে কলকাতার দু’টি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছে। তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আর এক
জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
পরিস্থিতি বিচারে এ দিন সন্ধ্যায় এইচপিএলের বোর্ড মিটিং হয়েছে। সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, আহতদের চিকিৎসার যাবতীয় বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের পরিবারের প্রতি। আহতদের উদ্ধার ও দ্রুত চিকিৎসার আয়োজনে রাজ্য সরকারের ভূমিকারও প্রশংসা করা হয়েছে। সংস্থার আশ্বাস, কর্মীদের সুরক্ষা ও কারখানার পরিবেশ রক্ষায় যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ক্ষেত্রে সংস্থার ইতিবাচক ভূমিকা যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃত, তা-ও জানাতে ভোলেননি কর্তৃপক্ষ।
ন্যাপথায় বিপদ
• অপরিশোধিত তেল শোধনের পরে উপজাত দ্রব্য হিসেবে মেলে তরল ন্যাপথা। তা পাইপলাইনে পেট্রোকেমে আসে।
• এ দিন ন্যাপথা ক্র্যাকার ইউনিটের ভালভ্ লাগোয়া পাইপলাইনে লিকেজ হওয়ায় বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল অতি দাহ্য গ্যাস হাইড্রোকার্বন।
• ভাল্ভের সঙ্গে লোহার পাইপের ধাক্কায় সামান্য স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। দ্রুত তা ছড়ায়।
• আগুন নেভাতে আসে দমকলের ১৪টি ইঞ্জিন।
• ২০০৯ সালেও হলদিয়া পেট্রোকেমের ন্যাপথা ইউনিটেই আগুন লেগেছিল।
অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়েই এ দিন পৌঁছন হলদিয়ার মহকুমাশাসক কুহুক ভূষণ, এসডিপিও তন্ময় মুখোপাধ্যায়, হলদিয়া পুরসভার চেয়ারম্যান শ্যামল আদকরা। পুরপ্রধান শ্যামল বলেন, ‘‘দুঃখজনক ঘটনা। আমরা স্থানীয় ভাবে অ্যাম্বুল্যান্সে করে অগ্নিদগ্ধদের কলকাতা পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেছি। চিকিৎসায় যাতে অসুবিধা না হয়, তা দেখতে আমিও কলকাতা যাচ্ছি।’’
ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ন্যাপথা এনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা ভেঙে পলিমার তৈরি হয় হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের ন্যাপথা ক্র্যাকার ইউনিটে। সংস্থা সূত্রে খবর, এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ সেই ন্যাপথা ক্র্যাকার ইউনিটেই বিস্ফোরণ হয়। এই ইউনিটের একটি ভাল্ভে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েছিল। কম্প্রেসার সংলগ্ন সেই ভাল্ভ মেরামত হচ্ছিল এ দিন সকালে। এই প্রক্রিয়ার পোশাকি নাম ‘কোল্ড মেনটেনেন্স’। নিয়ম মাফিক প্রথমে ভাল্ভ সংলগ্ন লিকেজ চিহ্নিত করার কাজ চলছিল। তখনই ভাল্ভের সঙ্গে লোহার পাইপ লাইনের ধাক্কায় আগুনের ফুলকি তৈরি হয়। মুহূর্তে একের পর এক যন্ত্রাংশে আগুন
ছড়ায়। মেরামতের কাজে ব্যস্ত এক জন আধিকারিক, ছয় স্থায়ী কর্মী এবং ছয় ঠিকাকর্মী আগুনের হলকায় ঝলসে যান।
গোটা ইউনিট তখন কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছে। বাইরে থেকেও দেখা যাচ্ছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর আগুনের শিখা। প্রাণ বাঁচাতে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে কর্মীদের মধ্যে। আগুন নেভাতে প্রথমে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের নিজস্ব ৭ দমকলের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। পরে আশপাশের শিল্পসংস্থার আরও ৭টি ইঞ্জিন আসে। ১৪টি ইঞ্জিনের তৎপরতায় ঘণ্টা তিনেকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।