(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কুণাল ঘোষ (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
ব্যবধান প্রায় ছ’মাসের। অগস্টে আরজি কর-কাণ্ডের পরে জুনিয়র-সিনিয়র নির্বিশেষে চিকিৎসকেরা ‘চাপ’ তৈরি করেছিলেন রাজ্য সরকারের উপর। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত নাগরিক আন্দোলন সেই ‘চাপ’ তৈরি করেছিল শাসকদল তৃণমূলের উপরেও। ছ’মাস পরে মধ্য জানুয়ারিতে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে এক প্রসূতি এবং এক সদ্যোজাতের মৃত্যুর ঘটনায় সরাসরি চিকিৎসকদের কাঠগড়ায় তুলল নবান্ন। মেদিনীপুরকাণ্ডে জুনিয়র-সিনিয়র নির্বিশেষে ১২ জন চিকিৎসককে সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মেদিনীপুরে প্রসূতির মৃত্যুর কারণ মেয়াদ-উত্তীর্ণ স্যালাইন না কি চিকিৎসকদের গাফিলতি, তা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহল সরগরম। গত সোমবার স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে পাশে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ চিকিৎসকদের গাফিলতির দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। সে দিনই রাজ্য সরকারের তরফে মেদিনীপুরকাণ্ডে তদন্তভার দেওয়া হয়েছিল সিআইডিকে। মঙ্গলবার তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ একাধিক ‘তথ্য’ উল্লেখ করে দাবি করেন, প্রসূতির চিকিৎসার সময়ে কোনও সিনিয়র ডাক্তার ছিলেন না। সবটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ‘কাঁচা’ হাতে। সরকারের ‘মুখ’ মুখ্যসচিব এবং শাসকদলের মুখপাত্রের পর পর দু’দিনের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, মেদিনীপুরকাণ্ডে নবান্ন এবং তৃণমূল একযোগে ডাক্তারদের ‘কোণঠাসা’ করতে চাইছে। সে দিন কুণাল যা বলেছিলেন, বৃহস্পতিবার সেই একই কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তার পর কুণাল কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। প্রশ্নের জবাবে পাঠানো বার্তায় লিখেছেন, ‘‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সবিস্তারে সবটা বলেছেন। আজ আলাদা কোনও প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া দেব না।’’ শেষেই একটি মৃদু হাসির ‘ইমোজি’। উল্লেখ্য, আরজি করের ঘটনার পরে দলের হয়ে যে হাতেগোনা কয়েক জন পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় গিয়েছিলেন, কুণাল তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবার চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে ‘কড়া বার্তা’ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য প্রশাসনের উদ্দেশে মমতার এ-ও নির্দেশ যে, অপারেশন থিয়েটারের বাইরের দরজা তো বটেই, ভিতরেও সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে। যাতে বোঝা যায়, কারা ডিউটি করছেন, কারা করছেন না বা কারও কাজে কোনও ‘গাফিলতি’ হচ্ছে কিনা। স্বাস্থ্যসচিবকে সরাসরি মমতা বলেন, ‘‘নিগম, এটা করবে! তার পর কেউ যদি বলে যে কাজ করবে না, তাকে বলতে হবে অন্য কোথাও যেতে। কিন্তু আমরা অবহেলায় মানুষের মৃত্যু বরদাস্ত করব না।’’ মেদিনীপুরকাণ্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দলকেও তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল নবান্ন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞদের কমিটি এবং সিআইডির রিপোর্ট মিলে গিয়েছে। সেটি ‘হাতিয়ার’ করেই ১২ জন ডাক্তারকে সাসপেন্ড করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সাসপেনশনের ঘোষণার সময়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এই রকম একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। তার পর আমরা যদি কোনও পদক্ষেপ না করি, তা হলে মানুষ আমাদের কী বলবেন!’’
উল্লেখ্য, আরজি কর নিয়ে আন্দোলন পর্বের মধ্যেই শাসকদলের তরফে একটি তালিকা প্রকাশ করে দাবি করা হয়েছিল, আন্দোলনের নামে ‘কর্মবিরতি’ চালিয়ে কত জন চিকিৎসক স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা করেছেন। তার জন্য রাজ্য সরকারের কত বাড়তি খরচ হয়েছে। গত ২১ অক্টোবর নবান্নে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে সেই তালিকা তুলে ধরেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। গত ২ জানুয়ারির প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, ওই চিকিৎসকদের চিহ্নিত করে পদক্ষেপ করতে হবে। অর্থাৎ, চিকিৎসকদের বিষয়ে রাজ্য সরকার যে ‘কঠোর’ মনোভাব নিচ্ছে, তা তখন থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
চিকিৎসকদের শাস্তি নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন আরজি কর-কাণ্ডে আন্দোলনের পুরোধা জুনিয়র ডাক্তারেরা। আন্দোলনের এক নেতা আসফাকুল্লা নাইয়া বলেছেন, ‘‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারের অপদার্থতা ঢাকতে চিকিৎসকদের বলির পাঁঠা করা হল!’’ প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার সকালেই আসফাকুল্লার কাকদ্বীপের বাড়িতে তল্লাশি করতে গিয়েছিল বিধাননগর থানার পুলিশ। যে প্রেক্ষিতে ওই জুনিয়র ডাক্তার ‘পুলিশি নিপীড়ন’-এর অভিযোগ তুলেছেন। ১২ জন চিকিৎসকের শাস্তি নিয়ে জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের অন্যতম নেতা দেবাশিস হালদার বলেন, ‘‘কর্নাটক সরকার স্যালাইন প্রস্তুতকারক সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করার পরেও তারা এই রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন সরবরাহ করত। আর সাসপেন্ড হলেন চিকিৎসকেরা। বাহ বাহ! এ তো একেবারে হীরক রাজ্য!’’
জুনিয়র ডাক্তারদের সুরেই সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন বিরোধীরা। বিজেপির সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যসচিবের ব্যর্থতা ঢাকতে চিকিৎসকদের উপর শাস্তির খাঁড়া নামিয়ে আনা হল। এটা আরজি করের বদলা! আমরা চাই, হাই কোর্টের এক জন বর্তমান বিচারপতি এবং দু’জন স্বাস্থ্যবিশেজ্ঞকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করে মেদিনীপুরকাণ্ডের তদন্ত হোক।’’ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘বদলা নয়, বদল চাই যে মুখ্যমন্ত্রীর মুখোশ, বদলা নেওয়াই যে তাঁর লক্ষ্য, এই ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে দিল। আরজি কর পর্বে আমরা জেনেছিলাম থ্রেট কালচারের কথা। এখন সেই থ্রেট কালচারের দ্বিতীয় পর্ব দেখছি। যেখানে নেপথ্য ভূমিকা নিচ্ছেন সরকারের আমলারা।’’
বিরোধীরা যখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘করুণ’ দশাকে বিঁধতে চাইছে, তখন পাল্টা মমতাও তাঁর শাসনকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কী কী পরিবর্তন হয়েছে, তার উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি তিনি এই বার্তাও দিয়েছেন যে, তাঁর সরকার মানুষের জন্য কাজ করবে। সরকারের কারও জন্য কোনও সাধারণ মানুষের প্রাণ গেলে তা বরদাস্ত করা হবে না। মমতার কথায়, ‘‘ডাক্তারদের প্রতি আমি সহানুভূতিশীল। কিন্তু কেউ যদি নিজের দায়িত্ব না পালন করেন আর তার জন্য যদি কারও প্রাণ চলে যায়, সেটা বরদাস্ত করব না।’’ সরকার এবং প্রশাসনের তরফে ডাক্তারদের উদ্দেশে দু’টি বার্তা দেওয়া হল বলে মনে করা হচ্ছে। এক, কে কোথায় ডিউটি করছেন কী করছেন না, তা সরকার নজরে রাখবে। দুই, কোনও গাফিলতি হলে সরকার রেয়াত করবে না।