কী ঘটল দিনভর? ছবি: সংগৃহীত।
বৃহস্পতিবার সাতসকালে চাঞ্চল্য বলিউডে। ভোরবেলায় মুম্বইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সইফ আলি খানকে। আচমকা অসুস্থতা নয়, বরং রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে একটি অটোরিকশায়। পটৌদী পরিবারের ‘ছোটে নবাব’-এর শরীরে ছ’টি আঘাত, এলোপাথারি ছুরির কোপ। তার মধ্যে দু’টি গুরুতর। কী এমন ঘটে গেল মুম্বইয়ে অভিজাত বান্দ্রা এলাকার তারকা নিবাসে?
মাঝরাতে ঘরে দুষ্কৃতী
বান্দ্রার ‘সৎগুরু শরণ’ ভবনের দ্বাদশ তলে সইফ আলি খান ও করিনা কপূর খানের সুখের সংসার। জানা গিয়েছে, বুধবার রাতে দিদি করিশ্মা কপূর ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করতে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী। রাত আড়াইটা নাগাদ তৈমুর, জেহ্র ঘরের দিক থেকে ভেসে আসে চিৎকার। ঘরের ভিতরই দেখা যায় এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে। প্রাথমিক তদন্তের পর মুম্বই পুলিশ জানতে পেরেছে, এক গৃহকর্ম সহায়িকার সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল ওই দুষ্কৃতী। সে সময় ইলিয়ামা ফিলিপ ওরফে আলিয়াস লিমা নামে ওই মহিলার চিৎকারেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সইফ। পুলিশের দাবি, সে সময় সইফের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় তার, দু’-তিন বার ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয় অভিনেতাকে। বাহু, ঘাড় ও মেরুদণ্ডে আঘাত লাগে তাঁর। জানা গিয়েছে, এ সময় দুই সন্তানকে নিয়ে ঘরেই ছিলেন করিনা।
সূত্রের খবর, গৃহসহায়িকা যখন ৩৫-৪০ বছরের ওই ব্যক্তিকে ঘরে দেখতে পান, তখন তাঁর চিৎকারে অন্য আর এক সহায়িকাও এসে পড়েন। ‘কী চান’, জিজ্ঞাসা করায়, সন্দেহভাজন ১ কোটি টাকা দাবি করে।
অটোরিকশায় হাসপাতালে
বৃহস্পতিবার দুপুরে মুম্বই পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (জ়োন ৯) দীক্ষিত গেদাম জানান, সইফকে জখম করার পরই ওই দুষ্কৃতী আপৎকালীন দরজা দিয়ে আবাসনের বাইরে বেরিয়ে যায়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশ ওই দুষ্কৃতীকে চিহ্নিতও করা গিয়েছে। তার খোঁজে তল্লাশি চলছে।
পুলিশের দাবি, ঘটনার পরই পটৌদী পরিবারের তরফে থানায় যোগাযোগ করা হয়। একটি সূত্র বলছে, তত ক্ষণে বান্দ্রার ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছন সইফ আলি খান ও অমৃতা সিংহের ছেলে ইব্রাহিম আলি খান। পারিবারিক এক কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে তিনিই জখম সইফকে নিয়ে যান ২ কিলোমিটার দূরে লীলাবতী হাসপাতালে। কিন্তু পারিবারিক গাড়িতে নয়, ভাড়া করা অটোরিকশায়। ইতিমধ্যেই এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কেন গাড়িতে নিয়ে যাওয়া গেল না সইফকে, সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। বিকেলে অবশ্য জানা যায়, ইব্রাহিম নয়। ওই পারিবারিক কর্মীই হাসপাতালে ভর্তি করান সইফকে।
আড়াই ঘণ্টার অস্ত্রোপচার
লীলাবতী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে জানা যায়, সইফের শরীরের দু’টি জখম গুরুতর। তাঁর মেরুদণ্ডে বিঁধে রয়েছে ভাঙা ছুরির ফলা। প্রায় আড়াই ঘণ্টায় দু’টি অস্ত্রোপচারের পর অভিনেতাকে বিপন্মুক্ত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
সইফের চিকিৎসক নিতিন দাঙ্গে বলেছেন, “শিরদাঁড়ায় গেঁথে ছিল ছুরি। ফলে শিরদাঁড়া থেকে সেরিব্রোস্পাইনাল তরল নির্গত হচ্ছিল। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেই ছুরি বার করা হয়েছে। ঘাড় ও হাতের চোটও যথেষ্ট গুরুতর ছিল। প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছে সেই আঘাতে।” অস্ত্রোপচারের পর সর্ব ক্ষণ নজরদারিতে রাখার জন্য সইফকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। জানা গিয়েছে, কশেরুকার এই আঘাত থেকে বড় ক্ষতি হতে পারত অভিনেতার। পঙ্গুত্ব থেকে মৃত্যু— কিছুই অসম্ভব নয়।
তদন্তে অপরাধ দমন শাখা
সকাল থেকেই সইফ-করিনার আবাসস্থলের বাইরে জড়ো হয়েছেন মুম্বই পুলিশের অপরাধ দমন শাখার আধিকারিকেরা। সেখানে দেখা যায় এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞ দয়া নায়েককে। দুপুরের পরে বৃহস্পতিবার মুম্বই পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (জ়োন ৯) দীক্ষিত গেদাম জানান, অভিযুক্তকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। পলাতক দুষ্কৃতীর খোঁজে তল্লাশি চলাচ্ছে মুম্বই পুলিশ।
প্রকাশ্যে ফুটেজ
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যেই সন্দেহভাজনের ছবি প্রকাশ করে মুম্বই পুলিশ। ঘটনার পর কী ভাবে ওই যুবক বাড়ি থেকে পালাচ্ছিল সেই ছবি ধরা পড়েছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। ভিডিয়োটিতে দেখা যাচ্ছে অভিযুক্ত সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সিসিটিভির দিকে তাকাচ্ছে। পিঠে একটি ব্যাগ (ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। এই ঘটনার তদন্ত করছে মুম্বই পুলিশের অপরাধদমন শাখা। ইতিমধ্যে সাত সদস্যের একটি বিশেষ দলও গঠন করা হয়েছে।
উদ্বিগ্ন বলিউড
বৃহস্পতিবার সকালেই লীলাবতী হাসপাতালে দেখা যায় শাহরুখ খানকে। সহ-অভিনেতার খোঁজ খবর নিতে পৌঁছন তিনি। দুপুরে বাবাকে দেখতে ভাই ইব্রাহিমের সঙ্গে হাসপাতালে আসেন সারা আলি খান। একাধিক বার দেখা যায় করিনা কপূরকে। বিকেলে হাসপাতালে আসেন অভিনেতার শ্যালক রণবীর কপূর, ভগ্নিপতি কুণাল খেমু।
কিন্তু এই ঘটনায় বলিউডের তারকারা মুম্বই ও বান্দ্রার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কারণ মাস কয়েক আগেই বান্দ্রায় প্রকাশ্যে খুন হয়েছেন রাজনৈতিক নেতা বাবা সিদ্দিকি। সলমন খানের বাড়ির বাইরে চলেছে গুলি। একাধিক বার প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়েছে ভাইজান বা তাঁর পরিবারকে। এ দিন রবীনা টন্ডন বলেন, “আসলে তারকাদের আক্রমণ করা এখন খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। একদা সুরক্ষিত এই এলাকার পরিস্থিতি এখন হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। জুলুমবাজি থেকে জমি দখল, হকারদের দৌরাত্ম্য এখন গোটা এলাকা জুড়ে। এ ছাড়া মোটরবাইকে চেপে গলার হার থেকে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এগুলি বন্ধ করতে পদক্ষেপ করতে হবে প্রশাসনকে।’’
সকালেই প্রতিক্রিয়া দেন প্রতিবেশী করিশ্মা তন্না। তিনি বলেন, “ওঁদের পরিবারের সঙ্গে যা হল মোটেই ঠিক নয়। তবে মানুষের শিক্ষা হল একটা।” অভিনেতার বড় বোন সাবা লন্ডন থেকে জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তিনি বিদেশে। দুশ্চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারছেন না। বুঝেই উঠতে পারছেন না কী করে অন্দরমহল অবধি পৌঁছে গেল দুষ্কৃতী।
রাজনীতির রং
মুম্বইয়ের অন্যতম অভিজাত পরিবারের উপর ঘটে যাওয়া এমন হামলায় বেআব্রু হয়ে পড়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, এমনই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। তবে, বিষয়টিকে আদৌ সে ভাবে দেখতে রাজি নন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস। তিনি জানিয়েছেন, ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে পুলিশ এবং প্রশাসন। কিন্তু তা বলে মুম্বইয়ের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। তাঁর দাবি, ‘‘দেশে সবচেয়ে সুরক্ষিত বড় শহর মুম্বই। ঘটনা গুরুতর। তা বলে মুম্বইকে অসুরক্ষিত শহরের তকমা দেওয়া ঠিক নয়।’’ সমস্ত ধরনের পদক্ষেপ করার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে।
তবে সইফের উপর হামলার পরেই মহারাষ্ট্রের বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে কটাক্ষ করেছে বিরোধীরা। শিবসেনা নেত্রী প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী বলেন, ‘‘মুম্বইয়ে খ্যাতনামীরা নিরাপদ না হলে কারা সুরক্ষিত?’’ তিনি নিজের এক্স হ্যান্ডল (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, ‘‘লজ্জাজনক ঘটনা। মুম্বইয়ে আরও এক জন বিশিষ্টকে খুনের চেষ্টা হল। তার পরেই মুম্বই পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠে গেল।’’
বিশ্নোই যোগ
সইফের উপর হামলার ঘটনায় অনেকই সন্দেহ করছেন এর সঙ্গে লরেন্স বিশ্নোইয়ের কোনও যোগ রয়েছে কি না! প্রায় ২৬ বছর আগে সলমন খানের সঙ্গে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সইফ। রাজস্থানে সে ছবির শুটিং চলাকালীন কৃষ্ণসার হরিণ শিকারের অভিযোগ ওঠে সলমনের বিরুদ্ধে। সে সময় তাঁর সঙ্গেই ছিলেন সহ-অভিনেতা সইফ, তাব্বুরা। বহু বছর পর সলমন কৃষ্ণসার শিকার মামলায় মুক্তি পেলেও বিশ্নোই সম্প্রদায়ের লরেন্স বিশ্নোই ও তার দলবল তাঁকে রেহাই দিতে নারাজ। ক্রমাগত প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলেছে তারা। সম্প্রতি বাবা সিদ্দিকির হত্যার পর লরেন্স-ঘনিষ্ঠেরা দাবি করেছে, শুধু সলমন নয়, অভিনেতা-ঘনিষ্ঠ কাউকেই তারা রেহাই দিতে নারাজ। এর পর নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে শাহরুখ খান ও সলমন খানের। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও সইফের উপর হামলার ঘটনায় তুলে এনেছেন সলমন ও বাবা সিদ্দিকির প্রসঙ্গ। সইফের উপর আক্রমণের পর কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্ত্রী করিনার নিরাপত্তা।
মাসির কাছে জেহ্, তৈমুর
পরিস্থিতি এমনই যে ওই বাড়িতে নাতিদের রাখতে সাহস পাচ্ছেন না ববিতা। এ দিন দুপুরেই নাতিদের নিয়ে করিশ্মার বাড়িতে চলে গিয়েছেন তিনি।
সন্ধ্যায় ছেলের কাছে শর্মিলা
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পরিবারের সদস্যেরা ছাড়াও বলিউডের বিশিষ্টেরা হাসপাতালে সইফকে দেখতে যান। সন্ধ্যায় ছেলেকে দেখতে হাসপাতালে পৌঁছন শর্মিলা ঠাকুর। সমাজমাধ্যমে হাসপাতালে বর্ষীয়ান অভিনেত্রীর ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালের বাইরে গাড়ি থেকে নামার পর কোনও সময় নষ্ট করেননি শর্মিলা। সোজা হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করেন তিনি। অভিনেত্রীর পরনে ছিল ছিল সাদা সালোয়ার-কামিজ়। গায়ে জড়ানো ছিল কালো শাল।