North Bengal

নিস্তব্ধতারও আছে শিল্পিত সৌন্দর্য

শহুরে কোলাহল ছেড়ে একটু নির্জন জায়গার খোঁজে বেরিয়ে পড়া। আর সে ব্যাপারে কখনওই নিরাশ করে না উত্তরবঙ্গ। 

Advertisement

সুভাশীষ দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৩ ০৭:২৭
Share:

কোলাহলের জীবন থেকে বেরিয়ে একটু অফবিট জায়গায় যাওয়াই উদ্দেশ্য। ফাইল চিত্র।

“অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ/ কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না/ যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না / আমার একটা নিজস্ব নদী আছে, সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।”

Advertisement

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমার মতো যাদের হৃদয় জুড়ে শুধুই পাহাড়, তাদের মধ্যে পাহাড়ে যাওয়ার ছটফটানি সব সময়ে থাকে। খুব সকালে আমাদের ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছল। কোলাহলের জীবন থেকে বেরিয়ে একটু অফবিট জায়গায় যাওয়াই উদ্দেশ্য। আগে থেকেই কয়েক দিনের জন্য গাড়ি বুক করে রাখা ছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে নেপালি ড্রাইভারটি হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এল। এর পর শুরু হল তিস্তাকে সঙ্গী করে আমাদের পাহাড়যাত্রা। এবার আমাদের ভ্রমণের জায়গাগুলি হল লাভা, লোলেগাঁও, নকদারা, গোম্বাদারা। শেষের দু’টি জায়গা ভ্রমণপিপাসু বাঙালিদের কাছে প্রায় অজানা। একদম নির্জন জায়গা এগুলি। ঠিক হল, আমরা রিশপ হয়ে নকদারা, গোম্বাদারা ও লাভা-লোলেগাঁও বেড়াতে যাব। ওখানে গিয়ে শুনলাম লোলেগাঁওয়ের ঝুলন্ত ব্রিজ আপাতত বন্ধ। এটা শুনে আমাদের মুখ পাহাড়ের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতোই ভার হয়ে গেল। সে কারণে লোলেগাঁওকে আমাদের ভ্রমণ তালিকা থেকে বাদ দিলাম।

Advertisement

ভোরবেলায় আমরা রিশপ থেকে নকদারার উদ্দেশে রওনা দিলাম। রিশপ থেকে নকদারার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। গাড়িতে প্রায় ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। কালিম্পং থেকে নকদারার দূরত্ব ৪০ কিমি আর লাভা থেকে ৯ কিমি। চরম ঠান্ডার মধ্য দিয়ে কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে সুবিশাল মসৃণ রাস্তা দেখতে পেয়ে আমরা নিজেরাই অবাক হলাম। পাহাড়ি এলাকায় এত চওড়া এবং মসৃণ রাস্তা সচরাচর দেখা যায় না। ভ্রমণের নতুন জায়গা নকদারা, তাই এই রাস্তাটিও নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘন বনের মধ্য দিয়ে মসৃণ রাস্তার উপর দিয়ে আমাদের গাড়ি এগোতে থাকল। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে চারপাশের জঙ্গলের সৌন্দর্য যে কাউকে এক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ অন্য রকমের ভাললাগায় ভরিয়ে দেবে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল বিভিন্ন পশু-পাখির ডাক, যেন একটা অন্য পৃথিবী। যেহেতু এই জায়গাটা একেবারেই জনবিরল তাই এখনও এখানকার সৌন্দর্য অটুট রয়েছে। ঘন পাইন, রডোডেনড্রনের জঙ্গলে পথের বাঁকে বাঁকে রহস্যময় সৌন্দর্য চেটেপুটে উপভোগ করতে লাগলাম আমরা। রাস্তার মধ্যেই গাড়ি থামিয়ে আমরা জঙ্গল দেখতে লাগলাম। করোনার পর থেকে এখানে পর্যটকের সংখ্যা বেশ কম। তাই পশুপাখির কোলাহলও যেন বেশি করে কানে আসছিল। কত সব অদ্ভুত নাম-না-জানা পাখির কিচিরমিচির মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। এদিকে আমরা যখন গাড়ি থামিয়ে একের পর এক ছবি তুলছি, তখন ড্রাইভার জানালেন, এখানে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারও রয়েছে। তাই জঙ্গল এলাকায় বেশিক্ষণ গাড়ির বাইরে থাকা সমীচীন হবে না। এরপর আমরা ফের রওনা দিলাম, মাঝে কিছু শুকনো খাবারও খেয়ে নিলাম। নিস্তব্ধতারও যে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে, সেটা এই রাস্তায় না এলে জানতেই পারতাম না।

ড্রাইভার জানালেন, প্রথমে আমরা গোম্বাদারার বৌদ্ধ মনাস্ট্রি দেখতে যাব। কিছুক্ষণ পরে গোম্বাদারা পৌঁছলাম। করোনার পরে পরিস্থিতি খানিকটা পাল্টে যাওয়ায় এই মনাস্ট্রিতে প্রথমে আমাদের ঢুকতে দিতে না চাইলেও পরে আন্তরিক ভাবে অনুরোধ করায় প্রবেশের অনুমতি মিলল শেষ পর্যন্ত। এর আগে একাধিক মনাস্ট্রি দেখেছি, কিন্তু প্রকৃতির কোলে এই মনাস্ট্রিটি দেখে আমরা কিছুক্ষণের জন্য একেবারে নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় এত সুন্দর বৌদ্ধ মঠ আর কোথাও দেখেছি কি না সন্দেহ। চারিদিকে সবুজের বাহার, পাখিদের অফুরান কলতানের মধ্যে সেই মনাস্ট্রি দেখার অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। কী অপূর্ব ব্যবহার সেখানকার লামাদের। আমাদের সঙ্গে কিছু ছবিও তুললেন ওঁরা।

অসম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এই মনাস্ট্রির প্রাঙ্গণ আশ্চর্য ঝকঝকে। এত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে বৌদ্ধ মঠ আর খুব বেশি নেই। নির্জন প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে যেন সেটি। মঠের পাশাপাশি পাহাড়ের উপরে এক বিরাট বুদ্ধমূর্তিও নির্মাণ করা হয়েছে এখানে। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এইসব পাহাড়ি জায়গায় এখনও নিষ্পাপ সরল মুখের ছড়াছড়ি। আর কিছু না হোক, এইসব জায়গায় মানুষের সরল হাসিই যে কোনও মানুষের মন ভরিয়ে দেবে। গুগলে সার্চ করলেও গোম্বাদারা সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না, জায়গাটি এতটাই অজানা। এবার গোম্বাদারাকে বিদায় জানিয়ে আমরা নকদারার উদ্দেশে রওনা দিলাম।

কিছুক্ষণ পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম নকদারা। একদম ছোট্ট একটি জনপদ। নকদারাতে যাওয়ার সময়ে দেখতে পেলাম, রাস্তার ধার দিয়ে নানা রকমের ফুলের সমাহার। এখানকার প্রত্যেকটি বাড়ি যেন এক-একটি বড় নার্সারি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৯৯৩ ফুট উঁচু জায়গাটি। কালিম্পংয়ের নকদারায় প্রায় দশ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে একটি ছবির মতন সুন্দর লেক। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এই লেকটির উদ্বোধন করা হয়েছিল। লেকের পাশে একটি মনোরম উদ্যান এবং লেক বরাবর ঝকঝকে মসৃণ লন তৈরি করা হয়েছে। এই লেকে বোটিং করার মজাই আলাদা। এইরকম নির্জন জনপদে এত সুন্দর ঝাঁ-চকচকে লেক আমরা আশাই করিনি। এমনকী এখানকার শৌচালয়গুলিও খুবই পরিচ্ছন্ন। ঠিক যেন কোনও ফাইভ-স্টার হোটেল কিংবা বড়সড় এয়ারপোর্টের ওয়াশরুম। নকদারা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাও পরিষ্কার দেখা যায়।

ফাইল চিত্র।

এরপর আমরা এখান থেকে লাভার উদ্দেশে রওনা দিলাম। রাস্তার মধ্যে গাড়ির পাশে একটি ছোট্ট হরিণ দেখতে পেলাম। এছাড়া অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের চিৎকারও কানে আসছিল যেতে যেতে। এই পুরো এলাকাটিই নেওড়া ভ্যালি ফরেস্টের অংশবিশেষ।

পড়ন্ত বেলায় পৌঁছলাম লাভা। হোটেলে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, আলু ভাজা, ডাল, মাছ, সবজি, চাটনি সহযোগে দুপুরের খাওয়া সারলাম। লাভায় ঠান্ডা বেশ ভালই অনুভূত হচ্ছিল। বিকেলের দিকে নেওড়া ভ্যালি ফরেস্টের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতেই আমরা চলে গেলাম অনেকটা পথ। পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভাললাগার ব্যাপার হল, হাঁটতে-হাঁটতে পাহাড় দেখা। জঙ্গলের ভিতরে ছোট ছোট এক কামরার কটেজগুলি দেখে খুব ভাল লাগছিল। কিন্তু করোনাকালে প্রায় সবক’টি কটেজই ফাঁকা। তারপর আমরা হাঁটতে হাঁটতেই লাভার বৌদ্ধ মনাস্ট্রিতে গেলাম। ওই সময়ে অতিমারির কারণে সেখানকার দরজা ছিল বন্ধ, তাই ঢোকা হল না। এবার আমার হাঁটতে হাঁটতে লাভা শহরের মধ্যেই একটা ওয়াটার রিজ়ার্ভার দেখতে গেলাম। একদম শেষে সন্ধেবেলায় গেলাম সেখানকার বাজারে। কিন্তু বিধি বাম, বেশিরভাগ দোকানই ছিল বন্ধ। তারপর রাত বাড়ার আগেই ফিরলাম হোটেলে। হোটেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অল্পবয়সি নেপালি মেয়েটি প্লেট ভর্তি করে মোমো নিয়ে এল। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা চা। রাতের খাওয়া সারলাম মাংস-ভাতে, সঙ্গে ডাল, আলুভাজা, বাঁধাকপি ইত্যাদিও। পরের দিন সকালবেলায় জলখাবার সেরেই আমরা ফের বেরিয়ে পড়লাম ওদলাবাড়ির চা-বাগানের উদ্দেশে। সেখানকার বিশাল চা-বাগানগুলি যেন দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছে। যেদিকে চোখ যায়, শুধুই চা-বাগান। এখানকার টি-এস্টেটগুলি দেখতে দেখতে যেন মনে হয়, সমুদ্রের অশেষ জলরাশি। খালি চোখে যার শেষ দেখা যায় না। উত্তরবঙ্গের অঢেল সৌন্দর্যে ক’টা দিন গা ভাসিয়ে শেষে বাড়ি ফেরার জন্য ফের নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়া। মনকেমনের সঙ্গীদের পিছনে ফেলেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement