অগভীর: ছোট নদী
বেড়াতে যাওয়ার জন্য একটু অন্য ধরনের লোকেশন কে না ভালবাসে! তাই খুঁজতে খুঁজতে তেমনই জায়গা পেয়ে গেলাম। এক রবিবার সকালবেলা ঘাটশিলা থেকে গাড়িতে রওনা। চিত্রকূট পাহাড়ে ওঠার রাস্তাকে বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে এক ঘণ্টা যেতেই পৌঁছলাম ছবির মতো সাজানো আদিবাসী গ্রামে, ‘ডাঙাডি’। গাড়ি থামল মাঠের ধারে। পায়ে হাঁটা পথে পৌঁছে গেলাম এক অচেনা দেশে।
নিঃশব্দ প্রকৃতির মাঝে পাথরের ফাঁক গলে তিরতিরিয়ে আপনমনে বয়ে চলেছে ছোট নদী, কালচে-সবুজ জলের কলকলানি। নদীর পাড়ে গাছের ডালে বসে থাকা নাম না জানা পাখির ডাক। মন উদাস হতে আর কী চাই? নদীর নামটিও বেশ, ‘খরস্রোতী’। বড় বোল্ডারের উপরে বসে নদীর জলে পা ভিজিয়ে কাটিয়ে দিলাম কিছুক্ষণ। দু’টি জলের ধারা এসে নদীতে মিশছে এক জায়গায়। এই দু’টি ধারার নামই ‘টোটোঝর্না’। সে এক অপরূপ দৃশ্য।
টোটোঝর্নাকে খরস্রোতীর কোলে রেখেই ফিরে এলাম ডাঙাডি গ্রামে। আলাপ হল ভূমিপুত্রদের সঙ্গে। তাঁদের সহজ-সরল ব্যবহারে কী ভাবে যেন তাঁদেরই একজন হয়ে গেলাম। স্থানীয় বাসিন্দা খগেন মুর্মু আর গড়ান হাঁসদার আন্তরিক ডাকে বাধ্য হলাম তাঁদের ঘরে যেতে। জল-বাতাসা খেতে খেতে তাঁদের মুখেই শুনতে থাকলাম স্থানীয় গল্প। দু’চোখ মুগ্ধতায় আটকে গেল মাটির দেওয়ালের আলপনায়।
মেঠো: গ্রামের মানুষ বেচে-কেনে
সময় বেশি নেই। ডাঙাডির মায়া কাটিয়ে গাড়িতে বসলাম। চিরুগোডা রেল স্টেশনের লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে এনএইচ ১৮ বরাবর ঝাড়গ্রামের দিকে এসে ডান হাতের রাস্তা ধরে এগোতেই পৌঁছলাম রাজবাড়ি। আদি রাজবাড়ির মাত্র দু’-এক শতাংশ এখনও রয়েছে। ধলরাজাদের শাসনকালে ঘাটশিলা ধলভূমগড় এস্টেটের অধীনে ছিল। রাজবাড়ি সংলগ্ন চত্বরে রয়েছে এমন কিছু মন্দির আর মূর্তি, যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ইতিহাস।
রাজবাড়ি ঘুরে প্রথমে এলাম রাসমঞ্চে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে। শ্বেত পাথরের রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। তাই এখানে কৃষ্ণের গাত্রবর্ণও সাদা। আটকোনা এই মন্দিরটি সপ্তদশরত্ন অর্থাৎ সতেরোটি চূড়াবিশিষ্ট। পরের মন্দিরটির চূড়া দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর। নন্দীদেবের মূর্তি দেখে প্রথমে শিবের মন্দির বলে ভুল করেছিলাম। কিন্তু গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গের বদলে তিনটি পাথরের শিলা দেখে মনে হল ঠিক যেন কাটরার বৈষ্ণোদেবীর প্রতিমূর্তি।
সেখান থেকেই গেলাম নাটমন্দির সংলগ্ন দুর্গামন্দিরে। কষ্টিপাথরে নির্মিত ফুট চারেকের অপরূপ মূর্তিটির থেকে চোখ ফেরানো দায়। প্রথমে কালীমূর্তি বলে মনে হলেও দশভুজার লোলজিহ্বাবিহীন শ্রীমুখ ভাল করে লক্ষ করে বুঝলাম এটি দুর্গামূর্তি। দুর্গামন্দিরের পাশেই ছোট আর একটি মন্দিরে কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিও নজর কাড়ল। এই ভীষণ-দর্শনা মূর্তিটি দেখে বৌদ্ধ-তান্ত্রিক দেবীর কথা মনে পড়তে বাধ্য। শিবমন্দির এবং মহালক্ষ্মী মন্দিরের বিগ্রহও যথেষ্ট আকর্ষক।
মন্দিরদর্শনের পরে চললাম রাজবাড়ি থেকে নামমাত্র দূরত্বে হাট দেখতে। ধলভূমগড়ের হাট ক্যানেল পাড়ে বসে প্রতি রবিবার। তবে আজ গরুর গাড়ির বদলে বংশীবদনরা এখন কলসি-হাঁড়ি নিয়ে আসে ম্যাটাডোরে চেপে। গাড়ি থেকে নেমে ক্যানেলের পাড় ধরে হাঁটতে থাকলাম। উচ্ছে থেকে কুলো, মোরগ থেকে মহুয়া... সবই মেলে এই হাটে। গ্রাম্য হাটের আনাচকানাচ ঘুরতে ঘুরতে নিজের অজান্তেই সওদার বোঝাটা বেশ ভারী হয়ে উঠল।