হিমাচলপ্রদেশের এক প্রান্তের শেষ গ্রামে গিয়েও একাধিক বাঙালি ভাতের হোটেল চোখে পড়বে। কারণ বাঙালি স্বভাবত ভ্রমণপ্রেমী।
বাঙালি এক কালে হোল্ডঅল নিয়ে চিঁড়ে-মুড়ি বেঁধে সদলবলে ট্রেনে উঠত। যে সে ভ্রমণ ছিল না। তাকে বলা হত ‘চেঞ্জ’-এ যাওয়া। মাস খানেকের জন্য গোটা পরিবার চলে যেত অন্য কোথাও। হয় গ্রীষ্মের ছুটিতে, না হয় পুজোর পর। দক্ষিণে হাওয়া বদলের জন্য যেতে বলতেন চিকিৎসকেরা। তখন গন্তব্য ওয়াল্টিয়ার। না হলে কাশী যাত্রা হত মাঝেমধ্যে। আর পাহাড় দেখতে হলে শিলং। রবিঠাকুরের অমিত-লাবণ্যের প্রভাব যে বহু দিন ধরেই চর্চিত বাঙালি ভ্রমণ ভাবনায়।
সত্যজিৎ রায়ের আমলে দার্জিলিং যাওয়ার চল বাড়ে। সপরিবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। মলের রাস্তা ধরে হেঁটে বেড়ানো। শাড়ির উপর লম্বা কার্ডিগন। সঙ্গে চাদর। আর মাংকি টুপি। এ সব ছাড়া বাঙালির পাহাড় দেখা ভাবাই যেত না।
তবে ভাত ছাড়া চলবে না। সে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন! কেদার-বদ্রি অথবা হরিদ্বারের মতো পাহাড়ি অঞ্চলে গেলেও একগুচ্ছ বাঙালি ভাতের হোটেল দেখা যায়। গরওয়াল অঞ্চলের কনকনে ঠান্ডায় থালার পর থালা ভাত-ডাল-আলু পোস্ত বেচে দিব্যি ব্যবসা করে চলেছে সে সব এলাকার দাদা-বউদির হোটেল। হিমাচলপ্রদেশের এক প্রান্তের শেষ গ্রাম, যেখানে ডাক্তার নেই, অধিকাংশ নিত্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে যেতে হয় বহু মাইল, সেখানেও গিয়ে একাধিক বাঙালি ভাতের হোটেল চোখে পড়বে। কারণ বাঙালি স্বভাবত ভ্রমণপ্রেমী। পকেটের জোর যেমন হোক, ঠিক বেরিয়ে পড়ত। ভক্তি থাকুক, না-ই বা থাকুক তীর্থস্থানেও পৌঁছে যেত। কোথাও কোথাও মাছ জুটত না বলে মন খারাপ হত। ‘কষ্ট’ করে পোস্ত আর ডাল দিয়ে কয়েকটি দিন চালিয়ে নিতে হত।
সে সব কালের বেড়ানোর একটা ধরন ছিল। মাংকি টুপি, উলের মাফলার, মুড়ি, আচারের শিশি, বিছানার চাদর, পারলে স্টোভও— সব যেত সঙ্গে। আর যেতেন বাড়ির আশি থেকে আট। একসঙ্গে। কারও হাঁটুতে ব্যথা, তাই পাহাড়ি পথে হাঁটবেন না। কারও দুপুরে না ঘুমলে চলে না। তাই বদ্রি পর্যন্ত পৌঁছেও হয়তো মন্দির দেখলেন না। তবু ছুটি কাটাতে যেতে হবে বাড়ির সকলে একসঙ্গে।
বাড়ির বউমা একা বিদেশে বেড়াতে গেলে পড়শিদের বলা হয় না। লোকে ভাববে বরের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক নেই। পরপর দু’টি ছুটিতে সপরিবারে কোথাও ট্রেক করতে গেলে সহকর্মী বলবেন— ‘এত টাকা বাঁচিয়ে কী করবেন? দু’জনে চাকরি করেন। গাড়ি ভাড়া করেই ঘুরুন না বাবা’!
বাঙালি স্বভাবে মধ্যবিত্ত। ভ্রমণের বাজেটও থাকত তেমন। পরিবারের সকলের মাথাপিছু দিনের খরচের হিসাব কড়া। বড় হোটেল তো নয়। হলিডে হোম কিংবা কোনও আশ্রম। আশ্রম মানে নিরামিষ। তাই বাড়ির বউয়ের স্নো-পার্ফিউমের বাক্সে ঢুকত পেঁয়াজ। আশ্রমের ঘরে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে মুড়ি মাখা হত সেই পেঁয়াজ দিয়ে। সে খোসা উড়ে বাইরে গেলে কেলেঙ্কারি। তা বলে কি খোসা ওড়েনি? বহু বার উড়েছে। আশ্রম মহলে কি আর বাঙালিদের এমনি এমনি নাম খারাপ? ভক্তির লেশ মাত্র নেই এ জাতির— এমনও শুনতে হয়েছে পরবর্তী পর্যটকদের।
তবে বাঙালির ভ্রমণের শেষে এ সব ঘটনা গল্প হয়ে থেকে যায়। লজ্জা বা ভুল নয়। ঘোরে পরবর্তী প্রজন্মের মুখে মুখেও। বাঙালি যত না খেটে বেড়াত, তার চেয়ে বেশি গল্পে বেড়ায় যে! এক জন কলকাতা ছেড়ে বাইরে গেলে সে গল্প শুনতে তাঁর বাড়িতে লোক জমত আগামী অন্তত বছর খানেক। ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখা, ম্যাগাজিন আমবাঙালির ঘরে ঘরে জনপ্রিয়। যাঁরা বেড়াতে যেতেন তাঁরা তো পড়তেন। যাঁরা যেতেন না, তাঁরাও সে সব লেখা পড়ে সুখ পেতেন।
এ কালের বাঙালি ইনটারনেট দেখে। টিভি-তে বিদেশি চ্যানেলে ভ্রমণের অনুষ্ঠান দেখে। পাহাড়ে গিয়ে নুডলস্ খেতে শিখছে। রাজস্থানে গেলে মাছ-ভাত নয়, লাল মাস খোঁজে। শাড়ি ছেড়ে চুড়িদার পেরিয়ে জগার্সে পৌঁছে গিয়েছে। পাহাড়ে গিয়ে কিছুটা হাঁটলে এখন তাকে ‘ট্রেক’ বলে। হাঁটা যতই কম থাক না কেন, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি নেই। বিশেষ স্পোর্ট সরঞ্জাম বিক্রির বিপণি থেকে জুতো, জামা আসে। সঙ্গে থাকে সিপার, হেড টর্চও। ছত্তীসগঢ়ের বাজারে গিয়ে ‘ইতনা মাছের কিতনা দাম’ না জিজ্ঞেস করে, তুলনায় পরিশীলিত হিন্দিতে কথা বলতে পারে। জঙ্গলে গেলে যে পা ঢাকা জুতো পরে ঘুরলে সুবিধা, তা বোঝে। কিন্তু তাই বলে কি বাঙালির ভ্রামণ-ভাবনায় বদল এসেছে?
কোনও ট্রাভেল এজেন্টকে জিজ্ঞেস করলে আসল উত্তর মিলবে। অথবা অমুক স্পেশ্যাল, তমুক ট্রাভেলস্-এর দলের আশপাশ দিয়ে ঘুরলে উত্তর হেঁটে আসবে। হোটেলের ভাল ঘর থেকে মাছের গাদা-পেটি— মরুভূমিতে সূর্যাস্ত দেখার ছলে সব নিয়ে ঝগড়া বাধে এখনও। তবু সদলবলে বেড়ানো চাই। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙেছে। পরিবারে ভাব কমছে। বন্ধু সকলের থাকে না। ট্যুর এজেন্টদের দলে বেড়ানো বাড়ছে। এখনও অনেকে মিলে ট্রেনে উঠতে ভালবাসে বাঙালি। খানিকটা সাহসও বাড়ে যে তাতে। হঠাৎ কোথাও একা বা দু’জনকে বেড়াতে দেখলে অন্য প্রদেশের বাসিন্দারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেই বসেন— ‘বাঙালিরা একা বেড়ায় নাকি’! ঠিক যেমন সাধারণ হোটেলের কর্মীর কাছে পরিষ্কার চাদর চাইলে বলেন— ‘বাঙালিরা তো বিছানার চাদর নিয়েই আসেন। একটু নিজেদেরটা পেতে নিন না’!
তার মানে কি সকলেই এক ভাবে বেড়ান? তা তো নয়। তবে বাড়ির বউমা একা বিদেশে বেড়াতে গেলে পড়শিদের বলা হয় না। লোকে ভাববে বরের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক নেই। পরপর দু’টি ছুটিতে সপরিবার কোথাও ট্রেক করতে গেলে সহকর্মী বলবেন— ‘এত টাকা বাঁচিয়ে কী করবেন? দু’জনে চাকরি করেন। গাড়ি ভাড়া করেই ঘুরুন না বাবা’!
আর যদি কেউ কোস্টাল ট্রেকে যান, তবে তো কথাই নেই। চারধারে অট্টহাসির রব। সমুদ্রে গিয়ে স্নান, বিয়ার, মাছ নিয়ে ফুর্তি না করে কি না বালির উপর দিয়ে হাঁটা! কষ্টের তো একটা মানে থাকে নাকি!
তবে কি বাঙালি ভ্রমণের গল্প এ রকমই? না। বাঙালি এবং ভ্রমণ মিলেমিশে বহু গল্প তৈরি হয়েছে। হবেও। এ শেষ হওয়ার নয়। সুইডেনে ছেলের কাছে বেড়াতে গিয়ে ইলিশ মাছের জন্য কান্নাকাটি, কিংবা নরওয়ের সুনসান শহরে কচুরি খাওয়ার জন্য মধ্য তিরিশের হাহাকার নিয়ে গল্প না হয় আর এক বছর হবে। বছর ঘুরলেই কি আর নব বাঙালি আসে নাকি!